মহালয়ার আগেই শুরু হয়ে গেল কাশীপুর রাজপরিবারের দুর্গাপুজো

উত্তরাপথঃ শুরু হয়ে গেছে কাশীপুর রাজপরিবারের দুর্গাপুজো । ঐতিহ্য মেনে প্রতিবারের মত এবারও মহালয়ার পাঁচদিন আগেই হয়ে গেল বোধন।মন্ত্র উচ্চারণ, আগমনী গান, বলি ও আরতির মাধ্যমে পঞ্চকোট রাজপরিবারে শুরু হয়ে গেল দুর্গাপুজো।এখানে মায়ের মন্ত্র গুপ্ত। গুপ্ত মায়ের আসনও। পুজোপাঠের মন্ত্র এতটাই গোপনীয় যে মন্ত্রের লিপি আজও অপ্রকাশিত।এক স্থানীয় বাসীন্দার মতে মায়ের পূজার মন্ত্র প্রায় ২০০০ বছর আগে গাছের ছালে সংস্কৃত ও পালি ভাষায় ন’টি পাতায় ন’টি লাইন লেখা। মায়ের পূজার সেই গুপ্ত মন্ত্র  ‘শ্রীনাদ’মন্ত্র নামে পরিচিত।      

এই বছর রবিবার আদ্রা নক্ষত্র যুক্ত কৃষ্ণ পক্ষের নবমী থেকে শুরু হয়েছে এবং চলবে মহানবমী পর্যন্ত। কাশীপুর পঞ্চকোট রাজপরিবারের দুর্গাপুজোর বিশেষত্ব হল এই পুজা হয় ১৬ দিনের, এই পুজো ষোলকল্পের দুর্গাপুজো নামেও পরিচিত। রাজপরিবারে সদস্যরা এই পূজার দায়িত্বে থাকেন। রাজপ্রসাদের ঠাকুরদালানে এই পূজার আয়োজন করা হয়। এখানে মা রাজরাজেশ্বরী রূপে পূজিত হন। অষ্ট ধাতু দিয়ে তৈরি মা দুর্গার মূর্তির চারটি হাত রয়েছে। এই পূজা খুব বিখ্যাত বলে মনে করা হয়। হাজার হাজার ভক্ত পূজায় অংশ নিতে আসেন।

কাশীপুর পঞ্চকোট রাজবংশের বংশধরেরা ক্ষত্রিয় হওয়ায় তারা ক্ষত্রিয় মতে শ্রী রামচন্দ্র কে অনুসরণ করে ৯ দিনের পরিবর্তে ১৬ দিন ধরে দুর্গাপূজার করেন। শ্রী রাম রাবণকে বধ করার জন্য ১৬ দিন ধরে যে ‘বোধন’ করেছিলেন যা ‘অকালবোধন’ নামে পরিচিত। সেই মত অনুসারেই ধারনগরের প্রথা এবং কুলাচারকে মেনে মহারাজা দামোদরশেখর সিং দেও বাহাদুর এই জঙ্গলমহলে দুর্গা পুজো শুরু করেন। দামোদর শেখরের নামানুসারে এই বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহলের ‘শেখরভূম’ বা ‘শিখরভূম’ নামকরণ হয়। তাই এই দুর্গার নামও হয় শিখরবাসিনী দুর্গা। এখানে ষোড়শ কল্পের ষোলটি রূপে মা পূজিতা হন। পঞ্চকোট রাজবংশের মন্দিরে সারা বছর মা থাকেন। এখানে এখনো বলি প্রথা চালু আছে।এই পূজাতে প্রতিদিন মা কে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়।

এই পুজোর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। নানা পৌরাণিক আখ্যান। মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নীর ধার নগরের মহারাজা বিক্রমাদিত্যের বংশধর জগদ্দেও সিং দেও এর কনিষ্ঠ পুত্র দামোদর শেখর সিং দেও বাহাদুর চাকলা পঞ্চকোটরাজের প্রতিষ্ঠাতা। এই রাজ্যস্থাপনের সময় থেকেই তার পূর্বপুরুষ কুলপ্রথা অনুযায়ী শকাব্দ ২ থেকে এই পুজো শুরু করেন ,বলে জানা যায়। এখানে মা ‘কে ঐতিহ্যশালী বেদিতে মার্বেল পাথরের একটি বড় সিংহাসনের উপরে একটি রুপোর সিংহাসনের মাঝে সোনার সিংহাসনের মাথায় বসিয়ে পূজা করা হয়। আর মহাসপ্তমীর দিন অর্ধরাত্রি থেকে দশমীর পূর্বাহ্ন পর্যন্ত মাকে গুপ্ত আসনে বসানো হয়। অষ্টাদশভূজা মহিষাসুরমর্দিনী রূপে আমরা মায়ের চরণে অঞ্জলি দিই।” মায়ের গুপ্ত আসনকে বলা হয় সোড়ন। এই সময় একটি তরোয়ালও পূজা পায়। যার নাম ‘ভূতনাথ তাগা’।

বর্তমানে কাশীপুর রাজপরিবারের দুর্গাপুজো দেবোত্তরের সেবাইত বিশ্বজিৎপ্রসাদ সিং দেওর তত্ত্বাবধানে ধুমধাম সহকারে হয়। এখানে পুরুষানুক্রমে একই পুরোহিতের বংশের ৮০তম পুরুষ ধরে এই গুপ্ত মন্ত্রে মায়ের পুজোপাঠ করে আসছে। শোনাযায় যে ভূর্জ পত্র বা গাছের ছালে মায়ের পূজার মন্ত্র লেখা রয়েছে তা দেখেই পুরোহিতেরা এত কাল পূজা করতেন কিন্তু বর্তমানে ভূর্জ পত্রের অবস্থা এতটাই করুণ যে হাত দিলেই ভেঙ্গে পড়ছে। তাই ওই ভূর্জ পত্র বিশেষ দিনে মায়ের চরণে রেখে মুখস্থ মন্ত্রে পুরোহিত পূজা করেন।

কথিত আছে এখানে অষ্টমীর দিনে দেবী মন্দিরে মা রাজরাজেশ্বরীর পায়ের ছাপ পাওয়া যায়। এটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু প্রতি বছর বহু মানুষ মায়ের পায়ের ছাপ দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে আসেন।মহারাজা বিক্রমাদিত্যের বংশধর রাজা কল্যাণ শেখর সিংদেবকে স্বপ্নে বলেছিলেন যে তিনি এখানে রাজরাজেশ্বরী রূপে প্রতিষ্ঠিত হবেন। তার অস্তিত্বের তথ্য জানাতে অষ্টমীর দিন তিনি তার পায়ের ছাপ রেখে যাবেন।

সেই থেকে আজও পরম নিষ্ঠা সহকারে এই কাশীপুর রাজপরিবারের দুর্গাপুজো পালন হয়ে আসছে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Vitamin-D: ভিটামিন ডি’র সেবন হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়

উত্তরাপথ: হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক সহ কার্ডিওভাসকুলার রোগগুলি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ।সম্প্রতি একটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা গেছে যে ভিটামিন ডি সম্পূরকগুলি ৬০ বছরের বেশি বয়সী লোকেদের হার্ট অ্যাটাক সহ যে কোনও বড় ধরনের কার্ডিওভাসকুলার অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে পারে৷ গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন ডি প্রায়ই "সানশাইন ভিটামিন" হিসাবে পরিচিত। এটি গ্রহণকারীদের মধ্যে স্ট্রোক সহ কার্ডিওভাসকুলার রোগ ৯% হ্রাস পেয়েছে । যা ২৮ জুন দ্য বিএমজে দ্বারা প্রকাশিত একটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top