ড. সায়ন বসু
ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ-বিন্যাসে থাকা রেডিও টেলিস্কোপগুলির নাম এবং অবস্থান সাথে পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া M87 নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝে থাকা কৃষ্ণগহ্বরের ছবি | ছবি – EHT ওয়েবপেজ এবং NASA
১৭৮৩ সালে ভূতত্ত্ববিদ জন মিচেল (John Michell) ‘ডার্ক স্টার’ (dark stars) শিরোনামে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তার গবেষণা পত্রের বিষয়বস্তু ছিল “বিপুল পরিমাণ ভর বিশিষ্ট কোন বস্তু যার মহাকর্ষের প্রভাবে আলোক তরঙ্গ পর্যন্ত পালাতে পারে না”। এখান থেকেই মূলত কৃষ্ণগহ্বরের (Black Hole) ধারণা আসে এবং এটি নিয়ে গবেষনা ও অনুসন্ধান শুরু হয়। পরবর্তিতে অবশ্য এটি বিজ্ঞান মহলে একটি অযৌক্তিক তত্ত্ব হিসেবে বেশ অবহেলার স্বীকার হয়। আলোর মত কোন কিছু বেরিয়ে আসতে পারবে না এমন একটি তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের কাছে বেশ অযৌক্তিক মনে হয়েছিল। তাই ধীরে ধীরে থেমে যায় কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষনা।
কিন্তু ১৯১৬ সালে প্রথম আলবার্ট আইনস্টাইন নিয়ে আসেন তার বিখ্যাত “সাধারন আপেক্ষিক তত্ত্ব”। তার এই তত্ত্বটি কেবল স্থান, সময়, মাধ্যাকর্ষণ এবং পদার্থের মধ্যকার সম্পর্কের বর্ণনাই দেয়নি, এটি একটি বিশেষ ঘটনার তাত্ত্বিক সম্ভাবনার দ্বারও উন্মুক্ত করেছিল| তার এই তত্ত্ব মহাবিশ্বের দুটি বস্তুর আকর্ষন এর জন্য দায়ী মহাকর্ষ বলের ধারণাকে পালটে দিয়েছিল। তার মতে একটি বস্তু মহাবিশ্বে একটি স্থান-কাল বক্র (Space-time curvature) করে রাখবে। একটি বস্তু যত ভারী তার স্পেস-টাইম বক্রতা তত বেশি। আর এই বক্রতার জন্যই কোন বস্তু তার আশেপাশের অন্য বস্তুকে নিজের দিকে টেনে আনবে যা আমরা মহাকর্ষ বল নামে চিনি। ব্যাপারটি এমন যে বস্তুটি স্পেস-টাইম কে বলে দেবে কতটুকু বাঁকতে হবে, আবার স্পেস-টাইম বক্রতা বস্তুটিকে বলে দেবে কীভাবে স্থানান্তরিত হতে হবে। তার এই অসাধারণ তত্ত্বের পর থেকেই শুরু হয় কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে পুনরায় মাতামাতি।
কৃষ্ণগহ্বরের তিনটি স্তর রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়; বহিঃস্ত ও অভ্যন্তরীণ ঘটনা দিগন্ত এবং সিঙ্গুলারিটি। ঘটনা দিগন্ত বা ইভেন্ট হরাইজন হল কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশের স্তর বা সীমানা, যা থেকে আলো পর্যন্ত বের হতে পারে না। যেহেতু অবিচ্ছিন্ন মাধ্যাকর্ষণ বল ঘটনা দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত তাই কোনও কণা এই দিগন্ত অতিক্রম করে বের হয়ে যেতে পারে না। প্রচণ্ড শক্তিশালী মধ্যাকর্ষন বল একে অভ্যন্তরে আটকে রাখে।
কৃষ্ণগহ্বরের তিনটি স্তর-এর ছবি | ছবি – astronomy.com
কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে অবস্থান সিঙ্গুলারিটির যেখানে সমস্ত ভর কেন্দ্রীভূত থাকে। এই বিন্দুতে স্থান-কালের বক্র অসীমে পরিণত হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সিঙ্গুলারিটির এলাকার আয়তন শূন্য কিন্তু ঘনত্ব প্রায় অসীম। এর কারণ হল প্রায় পুরো কৃষ্ণগহ্বরের ভর তার সিঙ্গুলারিটিতেই জমা হয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হল এই সিংগুলারিটি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারণা সবচেয়ে কম। তবে মনে করা হয় এই বিন্দুতে পদার্থবিজ্ঞানের সকল নিয়ম ভেঙ্গে পরে। স্থান কাল বলে এখানে কিছু নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কৃষ্ণগহ্বরের ছবি কি করে পাওয়া সম্ভব যে কিনা সমস্ত জাগতিক এবং মহাজাগতিক বস্তুকে গিলে ফেলে ? যেহেতু এখান থেকে কোন আলো বেরোতে পারে না তাই আমরা খালি চোখে এদের দেখতে পাই না। এদের দেখা না গেলেও আলবার্ট আইনস্টাইনের বিখ্যাত সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী মহাশূন্যে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব থাকতে পারে এবং এত ভারি ভরের কোন স্থান অবশ্যই তার চারদিকের স্পেস-টাইম বিকৃত করবে। সম্প্রতি এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই সম্ভব হয়েছে কৃষ্ণগহ্বরের প্রথম ছবি “তোলার”।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ঘটনা-দিগন্ত বা Event Horizon থেকে আলো বের হতে পারে না । কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে চক্রাকারে প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে থাকা বস্তু এবং কণাদের থেকে নিঃসৃত বিকিরণের তাপমাত্রা বিলিয়ন বিলিয়ন ডিগ্রী হয়ে থাকে। এগুলি কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে আলোর বেগে ঘুরতে থাকে এবং শেষে মিলিয়ে যায়। কিন্তু এই চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান কণাগুলির বিকিরণ থেকে খোঁজ পাওয়া যায় “মাঝের অঞ্চলের” যাকে বলা হয় “কৃষ্ণগহ্বরের ছায়া” যেটি ঘিরে থাকে একটি অতি উজ্জ্বল গোলাকার রিং-এর মতো অংশ ।
২০১৯ সালের ১০ই এপ্রিল গোটা পৃথিবীর সামনে আসে কৃষ্ণগহ্বরের ছায়ার ছবি । এই ছবি পাওয়ার জন্যে ব্যবহার করা হয় ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (Event Horizon Telescope)| এটি কোনও একটি রেডিও টেলিস্কোপ নয় বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি টেলিস্কোপকে নিয়ে তৈরি করা একটি টেলিস্কোপ-বিন্যাস যাকে বলা হয়ে থাকে রেডিও ইন্টারফেরোমিটার। বিভিন্ন জায়গায় থাকা রেডিও টেলিস্কোপগুলি একই দিনে, একই সময়, একই মহাজাগতিক বস্তু পর্যবেক্ষণ করে। পর্যবেক্ষণ শেষে বিজ্ঞানীরা সংগৃহীত ডেটা থেকে মহাজাগতিক বস্তু বা বস্তু সমূহের “ছবি” তৈরি করেন। ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ দিয়েও এই ভাবেই M87 (মেসিয়ার ৮৭) নামক একটি নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝে থাকা একটি কৃষ্ণগহ্বর পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল এবং তার ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল । এখানে বলে রাখা ভালো যে এই নক্ষত্রপুঞ্জটির দূরত্ব প্রায় ৫৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ (১ আলোকবর্ষ = ৯ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার) এবং যে কৃষ্ণগহ্বরটির ছবি প্রকাশিত হয়েছিল তার ভর হল সূর্যের ভরের ৬.৫ বিলিয়ন গুন ।
ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ-বিন্যাসে থাকে টেলিস্কোপগুলি হাওয়াই থেকে অ্যারিজোনা পর্যন্ত, মেক্সিকো থেকে স্পেন পর্যন্ত এবং চিলি থেকে দক্ষিণমেরু পর্যন্ত বিস্তৃত। এই টেলিস্কোপগুলো থেকে সংগৃহীত রেডিয়েশনকে এমন ভাবে সংকলন করে যেন মনে হয় এটি একটিমাত্র টেলিস্কোপ দ্বারাই সংগ্রহ করা হয়েছে। এই ভার্চুয়াল টেলিস্কোপটি যে চিত্র সংগ্রহ করে সেটি হচ্ছে ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজন থেকে যেসব কণা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন হিসেবে নির্গত হয় সেগুলোর “স্বাক্ষর”। এই দুর্বল রেডিয়েশনগুলোর অধিকাংশই হচ্ছে রেডিও তরঙ্গ। টেলিস্কোপের নজরে পড়ার জন্য রেডিও তরঙ্গগুলোকে কয়েক ট্রিলিয়ন কিলোমিটার অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে পাঁচ রাত ধরে আমাদের মিল্কিওয়ে মধ্যবিন্দুতে থাকা M87-এর কৃষ্ণগহ্বরকে পর্যবেক্ষণ করে। যে ডাটা বের করা হয়েছিল টেলিস্কোপগুলো থেকে সেগুলো এতটাই বিশাল ছিল যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ট্রান্সমিট করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। এগুলোকে একটি ডিস্কে রেকর্ড করতে হয়েছে এবং বোস্টনে অবস্থিত ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT) তে শিপিং এর মাধ্যমে পাঠাতে হয়েছে। দক্ষিণ মেরু থেকে ডাটা সংগ্রহ করে পাঠাতে প্রায় এক বছরের মতো লেগে গিয়েছিল। সংগ্রহ করা ডাটার আকার ছিল ৪ পেটাবাইট। ডাটাগুলোকে সুপার কম্পিউটার দ্বারা প্রসেস করতে বিজ্ঞানীদের দলকে ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা করে শিফটে কাজ করতে হয়েছে। প্রথমে শুধুমাত্র M87-এর কৃষ্ণগহ্বরের ছবি প্রকাশ করা হলেও ২০২২ সালের মে মাসে প্রকাশ করা হয় আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মাঝে থাকা কৃষ্ণগহ্বর স্যাজেতেরিয়াস-এ* (Sgr A*) এর ছবিও । আর এভাবেই সর্বপ্রথম আমরা দেখতে পাই কৃষ্ণগহ্বরের প্রকৃত “ছায়া” ও “ছবি”।
এখানে উল্লেখ করে রাখা দরকার যে ২০২০ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার প্রাপক তিনজনের মধ্যে দুজন, অধ্যাপক রেনহার্ড গন্জেল এবং অধ্যাপিকা আন্দ্রেয়া গেজ পুরস্কৃত হয়েছিলেন তাদের আবিষ্কারের জন্যে যেখানে তারা প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন একটি অতীব ভারি বস্তুর উপস্থিতি আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রস্থলে| তারই ঠিক দু’বছর পরে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ প্রোজেক্ট থেকে প্রকাশিত হয় স্যাজেতেরিয়াস-এ* এর ছবি ।
ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ-বিন্যাস থেকে প্রকাশিত Sgr A* কৃষ্ণগহ্বরের ছবি | ছবি – EHT ওয়েবপেজ |
ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ প্রোজেক্ট সম্বন্ধে জানতে চোখ রাখুন – https://eventhorizontelescope.org/
২০২০ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার সম্বন্ধে জানতে চোখ রাখুন – https://www.nobelprize.org/prizes/physics/2020/summary/
*লেখক বর্তমানে University of Witwatersrand-এর Centre for Astrophysics-এ কর্মরত রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির গবেষক এবং SKA প্রোজেক্টের অংশ | সাথে উনি HartRAO অবজারভেটরির পূর্বতন গবেষক |
যোগাযোগ- sayan.basu@wits.ac.za
Excellent Article!