বাংলার কারিগরদের নৈপুণ্য এবং আবেগ মা দুর্গাকে জীবন্ত করে তুলেছে মরু শহরে

প্রীতি গুপ্তা, উদয়পুর – কথায় বলে বিশ্বের সম্ভবত এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে বাঙালি নেই ।উদয়পুর রাজস্থানের কেন্দ্রস্থলে, অবস্থিত একটি শহর যা তার মহিমান্বিত প্রাসাদ ,লেক এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত। প্রতি বছর এখানে হাজার হাজার বাঙালি পর্যটক শুধুমাত্র এই শহরটিতে ঘুরতে আসেন,এছাড়াও এখানে যথেষ্ট সংখ্যায় প্রবাসী বাঙালি রয়েছেন যারা  বিভিন্ন কাজের জন্য উদয়পুরে এসে বর্তমানে অস্থায়ীভাবে বা স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন । উদয়পুরের দুর্গা পূজার মূল উদ্যোক্তা সেইসব বাঙালীরা যারা বর্তমানে এই শহরে বাসবাস করছেন।এখানকার দুর্গা প্যান্ডেলে কলকাতার মত অত জৌলুস নেই তবে এটি প্রবাসে এমন একটি মঞ্চ যেখানে শত শত বাঙালি এই পূজা উপলক্ষে একত্রিত হওয়ার সুযোগ পায়।

জানা যায় উদয়পুরে দুর্গা পূজা শুরুর ইতিহাস ১৯৫৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং উদয়পুর আইন কলেজের অধ্যক্ষ এন এল ভট্টাচার্যের হাত ধরে।সেই থেকে গত ৬৮ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী রীতি মেনে বিন্দু ভবন অশোক নগরে দুর্গাপূজা উৎসবের আয়োজন হয়ে আসছে।

লোকমুখে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায় উদয়পুরে প্রায় ৬২ বছর আগে শাস্ত্রী সার্কেলে অবস্থিত চ্যাটার্জি বাংলোতেও দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো। পরবর্তী সময়ে মহারাষ্ট্র ভবন কয়েকদিন ভাড়ায় নিয়ে পুজো করা হতো ।১৯৮২ সালে, ইউআইটি ভূপালপুরায় বঙ্গ ভবনের জন্য জমি দেয়, তারপর থেকে সেখানেই  দুর্গাপূজার উদযাপন শুরু হয়। সম্পূর্ণ বাঙালি রীতিনীতির সঙ্গে এখানে পূজা হয়। এখানে সপ্তমীতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও প্রসাদ বিতরণ অনুষ্ঠান হয়। অষ্টমী পূজা উপলক্ষে এখানকার বাঙালি সম্প্রাদায়ের বহু মানুষ এখানে দেবী দর্শন ও পূজার জন্য সমবেত হন। এখানে ১০৮টি পদ্মফুল দেবীকে নিবেদন করা হয়। একই সঙ্গে নবমীতে সকালে পূজা ও যজ্ঞ হয় এবং দশমীতে বিসর্জনের অনুষ্ঠান হয়।ঐতিহ্য মেনে সেদিন বিবাহিত মহিলারা যথারীতি সিন্দুর খেলার ঐতিহ্য অনুসরণ করেন।

এছাড়াও উদয়পুরে সেক্টর ৪ ব্রাহ্মণ সমাজসেবা কমপ্লেক্সে প্রায় ২৫ বছর ধরে দুর্গাপূজার আয়োজন হয়ে আসছে ।সেখানেও সম্পূর্ণ বাঙালি মতে পূজা সম্পূর্ণ করা হয়। এখানে বিজয়াদশমীতে দশমী পূজা ও অপরাজিতা পূজার পর সন্ধ্যায় শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিমা বিসর্জন করা হয়।

উদয়পুরের দুর্গা পূজার ইতিহাস যদিও অনেক সাম্প্রতিক তবু এখানে দুর্গা পূজা উপলক্ষে তিন মাস আগে থেকে বাংলা থেকে কারিগররা আসে মূর্তি তৈরির জন্য । এবছর বাংলা থেকে চারজন কারিগর এসেছেন বলে জানা গেছে । তারা বাংলা থেকে ৫০ কেজি করে গঙ্গার মাটি নিয়ে এসেছে।এখানে প্রথমে মূর্তিটির গোড়া চারা এবং কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয় এবং মেওয়ারের মাটি তিন স্তরে প্রয়োগ করা হয় মাটির প্রতিটি স্তর শুকাতে ৩ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। স্থানীয় মাটির স্তরে ফাটল দেখা যায়, তাই মূর্তির সামনের অংশ  গঙ্গার মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়। কলকাতা থেকে আনা চুল, অস্ত্র, মুকুট ,জল রং ইত্যাদি ব্যবহার করে মূর্তিটিকে সাজানো হয়। কারিগরদের মতে রাজস্থানের অনেক জায়গা থেকে এই মূর্তির চাহিদা আসে কিন্তু সীমিত সময়ের মধ্যে আমরা সব চাহিদা পূরণ করতে পারি না।

উদয়পুরের দুর্গাপূজাকে যা আলাদা করে তা হল বাঙালি এবং রাজস্থানী সংস্কৃতির এক অনন্য সংমিশ্রণ। উদ্যোক্তারা স্থানীয় রাজস্থানী সংস্কৃতির উপাদানগুলি যেমন রাজস্থানী সঙ্গীত এবং নৃত্যের একটি মন্ত্রমুগ্ধকর মিশ্রণ অন্তর্ভুক্ত করে দুর্গা পূজা উদযাপনে। এটি এক মিশ্র ঐতিহ্যবাহী শৈলী এবং কৌশল তৈরি করে যা উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ সমানভাবে উপভোগ করে। এককথায় উদয়পুরের দুর্গাপূজা হল  উদযাপন এবং সংস্কৃতির একটি প্রাণবন্ত সংমিশ্রণ যা সীমানার ঐতিহ্যকে অতিক্রম করে। বাংলার কারিগরদের নৈপুণ্য এবং আবেগ মা দুর্গাকে জীবন্ত করে তুলেছে এই মরু শহরে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


রবি কিরণে “আদিত্য”

ড. সায়ন বসুঃ বীর "বিক্রমে" চাঁদের মাটিতে পা রাখার পর এবার ভারতীয় মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র (ISRO)-এর লক্ষ্য সূর্য | আমাদের ৮টি গ্রহ (প্লুটো এখন বামন গ্রহের তালিকায়) যাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সেই সূর্যের দিকে পাড়ি দিয়েছে "আদিত্য" ২রা সেপ্টেম্বর| চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের ১০ দিনের মাথায় আদিত্যকে সূর্যের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়ে ISRO বাকি বিশ্বের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রগুলির কাছে যে একটি শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছে তা বলাই বাহুল্য| আদিত্য মিশনের সূচনা ২০০৮ সালের জানুয়ারী মাসে মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কিত একটি উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে|প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয় যে একটি ছোট এবং কম ওজনের (৪০০ কেজি) কৃত্রিম উপগ্রহকে low Earth orbit (LEO ;লিও) যে কক্ষপথের উচ্চতা ১,২০০ কিলোমিটারের থেকে কম সেখানে পাঠানো হবে এবং তার কাজ হবে সূর্যের একদম যে বাইরের স্তর যাকে আমরা সৌর-করোনা বলি তার সম্বন্ধে তথ্য পাঠানো। .....বিস্তারিত পড়ুন

সালাদ খাওয়া'র সেরা সময়: খাবার আগে না পরে?

উত্তরাপথঃ আজকাল অনেক ডাইয়েটিশিয়ান সুস্থ থাকতে খাবারে বিশেষ করে সালাদ অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন।  কারণ এতে অনেক ধরনের শাকসবজি, ডাল এবং ফল রয়েছে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষভাবে উপকারি। কিন্তু সালাদ খাওয়ার সেরা সময় কখন তা নিয়ে মানুষ খুব বিভ্রান্তিতে পড়ে, খাবার পরে না আগে খাবে বুঝতে পারে না।কেউ কেউ যুক্তি দেন যে খাবারের আগে সালাদ খাওয়া হজমে সহায়তা করে এবং  বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত উপকারিতা প্রদান করে,আবার আরেক দল বিশ্বাস করে যে খাবারের পরে এটি খাওয়া আরও উপকারী। আসুন উভয় দৃষ্টিভঙ্গি অন্বেষণ করি এবং প্রতিটি পদ্ধতির সম্ভাব্য সুবিধাগুলি বিবেচনা করি। খাবার আগে সালাদ খাওয়া: খাবারের আগে সালাদ খাওয়া ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। শাকসবজির উচ্চ ফাইবার সামগ্রী এবং জলের উপাদান পূর্ণতার অনুভূতি তৈরি করতে পারে, যা মূল কোর্সের সময় ক্যালোরি গ্রহণকে হ্রাস করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

জলবায়ু পরিবর্তন আমাজনের রেইনফরেস্টের কিছু অংশকে সাভানাতে রূপান্তরিত করতে পারে

উত্তরাপথঃ আমাজন রেইনফরেস্ট, যাকে "পৃথিবীর ফুসফুস" হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুত্তন্ত্র যা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।সম্প্রতি প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেসের বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে একটি নতুন তত্তের বর্ণনা করা হয়েছে ,সেখানে বলা হয়েছে কীভাবে বর্ষার মৌসুমে বিকল্প বন্যা এবং শুষ্ক মৌসুমে খরা, যাকে ডবল-স্ট্রেস বলা হয়, বন প্রতিষ্ঠাকে সীমিত করছে।উদ্বেগজনক গবেষণাতে আরও বলা হচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন-প্ররোচিত খরা আমাজন রেইনফরেস্টের কিছু অংশকে সাভানাতে রূপান্তরিত করতে পারে, যা জীববৈচিত্র্য এবং সামগ্রিকভাবে গ্রহের জন্য সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি আনতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top