প্রিয়াঙ্কা দত্ত


ছবি প্রতীকী
ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপীয়রা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে না এলে ভারতের ইতিহাসে যে কি হতো তা বলা মুশকিল । তবে ভারতবাসী যে বহু রসনার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতো সে কথা বলা বাহুল্য। ইউরোপ থেকে আফ্রিকা আর আমেরিকার পর ওলন্দাজ নাবিকরা যখন কলিকট বন্দরে পৌঁছালো সেই তখন থেকেই প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনের সূচনা। প্রাচীণ ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গনে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো বিদেশি সভ্যতার নানান আঙ্গিক, যার মধ্যে খাদ্যাভাস অন্যতম।
পশ্চিম ভারতে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার পর পর্তুগিজরা প্রথম ইউরোপীয় হিসাবে বাংলায় আসে ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে। বাংলায় পূবের চট্টগ্রাম আর পশ্চিমে হুগলির সপ্তগ্রাম ছিল তাদের মূল ঘাঁটি। পরে অবশ্য ব্যান্ডেলে তারা জমিয়ে বসেছিল। কিন্তু সমস্যা হোলো খাবার নিয়ে । এ দেশের সাদামাটা শাক ভাত বা মাছ খাওয়া তাদের রুচিতে ধরলো না। শুরু হলো বিকল্পের সন্ধান । আর সেই সূত্রেই বাংলার মানুষ পরিচিত হতে থাকলো বিদেশি খাদ্যের সঙ্গে। বাঙালির খাদ্য তালিকায় যুক্ত হল এমন সব খাবার যা ছাড়া আজকের বাঙালি কুইজেন ভাবাই যায় না।
প্রথমেই আসি মিষ্টির কথায় । মিষ্টি যে বাঙালি নিজস্ব কৃতিত্ব নয় এ কথা যেন কানে বাজে । রকমারি মিষ্টি তৈরির যে মূল উপাদান , সেই ছানা তৈরি করতে জানতো না বাংলার মানুষ। প্রাচীন ভারতে ছানা ছিল পরিত্যাজ্য বস্তু কারণ তা হলো নষ্ট দুধ। কিন্তু সেই ছানাই যে গুর আর চিনির সঙ্গে জোট বেঁধে অসাধারণ সব মিষ্টির রূপ নিতে পারে তা কিন্তু শিখিয়েছিল পর্তুগিজরা। সেই মিষ্টি ই এখন বিশ্ব জুড়ে বাংলার পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। পর্তুগিজরাই দুধ থেকে ছানা, পনীর, চিজ তৈরির পদ্ধতি শেখায় বাঙালিদের। আর কালক্রমে তাই ঢুকে পড়ে বাঙালির রান্না ঘরে। পর্তুগীজদের দেখানো বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরী ব্যান্ডেল চিজ বা ঢাকাই পনীর তো এখনও জগৎবিখ্যাত।
আলু আর কাঁচা লঙ্কা ছাড়া বাঙালি মেনুর কথা ভাবা যায়? অথচ সেই গোল আলু আর কাঁচালঙ্কা কিন্তু বাঙালির নিজস্ব নয়। তারও আমদানি পর্তুগিজদের হাত ধরে। ভাবলে অবাক হতে হয় যে, বাংলায় আগে কাঁচা লঙ্কা বা শুকনো লঙ্কার চল ছিল না। ঝাল বলতে ব্যবহৃত হতো গোলমরিচ বা পিপুল । কিন্তু ক্রমে কাঁচা লঙ্কা চাষের পদ্ধতি আর ব্যবহার শুরু হয় পর্তুগিজদের উদ্যোগে । শুধু তাই নয় , বাংলার ফলের আসরে পেয়ারা, আনারস , কাজু বাদাম , চিনেবাদাম বা আঙ্গুরের মতো অতি পরিচিত ফলের আমদানি করে এই পর্তুগিজরা । আমাদের অতি আদরের পথ্য পেঁপেও পেয়েছি তাদেরই বদান্যতায়। টমেটো , রাঙা আলু ,বেগুন ,ঢেঁড়স বা বিভিন্ন ধরনের কপি অর্থাৎ ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি এসবও আমরা ওলন্দাজ বণিকদের কাছেই খেতে শিখেছি। আজকাল বাঙালির সবজির বাজারে এদের রমরমা অথচ একসময় এসব সবজির ব্যবহার বাংলায় প্রচলিত ছিল না। তবে এতো সব শাকসবজি যে পর্তুগিজদের নিজস্ব তা কিন্তু নয়। তারাও আমেরিকা, আফ্রিকা বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজে করে সেসব নিয়ে পাড়ি দিত ভারতবর্ষে। আর ধীরে ধীরে তাই ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে ভারতীয়দের একান্ত আপন।
চাটনি বা আচারের পেছনেও কিন্তু এই ওলন্দাজদের হাত । কারণ তারা কেবল ফলমূল আমদানি করেই ক্ষান্ত ছিলেন না । তা কিভাবে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় তার ব্যবস্থাও চালু করেছিলেন। মোরব্বা আচার বা চাটনি তৈরীর মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে আনারস, আম বা টমেটো জারিত করে ব্যবহার করতে শিখিয়েছিলেন তারা।
বাঙালির আরও এক প্রিয় পদ শুক্ত। তাও তার নিজের নয়। এও পর্তুগিজদেরই শেখানো এক রান্না। বেকারি শিল্পের প্রাথমিক রসদও তৈরি করেছিল এই পর্তুগিজরা। তাদের হাত ধরে ভারতবাসী প্রথম পাউরুটির স্বাদ পায়। বর্তমানে কেক, পেস্ট্রি বা বান রুটির মতো খাবার খাওয়ার আগে একবার পর্তুগিজদের নাম স্মরণ করে নেওয়া ভালো। তারা যদিও ভারতে ইস্টের বদলে তারি দিয়েই তাদের রুটি ফোলাতো। তবে আটার সাহায্যে এসব সুস্বাদু খাবার তৈরীর কৌশল কিন্তু মূলত ইউরোপীয়দের অবদান।
এখন যে কোন রেসিপিতে ম্যারিনেশন করে রাখার যে পদ্ধতি আমরা অহরহ অনুসরণ করছি তাও সেই ওলন্দাজদেরই শেখানো।
যে তামুক বা তাম্বাকু সেবন রেনেসাঁ যুগের বাঙালি বাবুদের থেকে বর্তমান প্রজন্মকে সমানে আকর্ষণ করে চলেছে তার সঙ্গেও পরিচয় করায় এই পর্তুগিজরা। এরকম জানা অজানা হাজার ফিরিস্তি দাখিল করা যায় এই বিদেশি জাতির অবদান হিসাবে।
বাঙলা ছাড়াও আর এক রাজ্য গোয়ার নিজস্ব খাদ্য তালিকায় একেবারে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে গেছে পর্তুগিজ প্রভাব। ভিন্ডালু, পাওভাজি বা গোয়ান বেবিঙ্কা এসব হরেক রকম স্বাদের পদ আসলে পর্তুগিজ আর দেশীয় স্বাদের মেলবন্ধনের ফল।
শুধু পর্তুগিজই নয়, এভাবেই প্রায় সমস্ত আগত বিদেশিদের কিছু না কিছু খাদ্যাভাস অজান্তেই আমরা নিজের করে নিয়েছি। বিশুদ্ধ ভাবে না হলেও দেশী স্টাইলে তারা এখন আমাদের নিত্য আহার্যের অঙ্গ। বিশ্ব সাথে যোগাযোগ রক্ষার এর চেয়ে উত্তম পন্থা আর কিই বা হতে পারে! রসে বসে এভাবেই বেঁচে থাক বাঙালির হেঁসেল।
আরও পড়ুন
Side effects of vitamin: ভিটামিনের আধিক্য আপনার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে
উত্তরাপথঃ ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা আমরা সবাই নিশ্চয়ই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি যে সুস্থ থাকতে হলে শরীরে প্রয়োজনীয় সব ভিটামিন থাকা খুবই জরুরি। ভিটামিন আমাদের সুস্থ করার পাশাপাশি আমাদের সমগ্র শরীরের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাইহোক, এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া আমাদের জন্য ক্ষতিকারকও হতে পারে। আসুন জেনে নিই অতিরিক্ত ভিটামিন গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effects of vitamin)সুস্থ থাকার জন্য শরীরে সব ধরনের পুষ্টি থাকা খুবই জরুরি। এ কারণেই বয়স্ক থেকে শুরু করে চিকিৎসক, সবাই আমাদেরকে সুষম ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন। সমস্ত পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে সুস্থ করে তোলে। এর মধ্যে ভিটামিন একটি, যা আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। .....বিস্তারিত পড়ুন
World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?
প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন
প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে
উত্তরাপথঃ হঠাৎ করেই একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে।২০২৩ এর ৩০ অক্টোবর প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি মৃত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একটি নতুন দ্বীপের জন্ম দিয়েছে। বিস্ফোরণের পর জাপানের ওগাসাওয়ারা দ্বীপ চেইনের কাছে বিশাল বিশাল পাথরের টুকরো দেখা গেছে। এ বিষয়ে জাপানি গবেষক বলেন, গত মাসে প্রশান্ত মহাসাগর জলের নিচে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইওটো দ্বীপের কাছে একটি ছোট নতুন দ্বীপের উদ্ভব হয়েছে।টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফুকাশি মায়েনো জানিয়েছেন যে নতুন দ্বীপ, এখনও যার নাম নেই প্রশান্ত মহাসাগরের ইওটো দ্বীপ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ১০০ মিটার ব্যাসের একটি পাথুরে দ্বীপে একটি phreatomagmatic বিস্ফোরণ ঘটেছে। টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিস্ফোরণটি দেখা গেছে। ভূপৃষ্ঠের নীচে জলের সাথে লাল গরম ম্যাগমা সংঘর্ষের কারণে প্রতি কয়েক মিনিটে বিস্ফোরণ ঘটে।গত ২১ অক্টোবর, ২০২৩-এ অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল, যা আগে ইও জিমা নামে পরিচিত ছিল এবং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্থান ছিল। প্রায় ১০ দিন ধরে অগ্ন্যুৎপাত চলার পর, আগ্নেয়গিরির উপাদান অগভীর সমুদ্রতলের উপর জমা হয় এবং প্রায় ১৬০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বড় বড় পাথরের আকারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে। .....বিস্তারিত পড়ুন
সম্পাদকীয়- রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র
সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল। আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন