মহারানী পদ্মাবতী এবং জোহরের ঐতিহ্য: সাহস ও আত্মত্যাগের এক গল্প

মহারানী পদ্মাবতী উদয়পুরে এই দুর্গে থাকতেন ছবি সৌজন্য -উত্তরাপথ

উত্তরাপথঃ ভারতের ইতিহাসে, এমন অনেক গল্প রয়েছে যা সময়কে অতিক্রম করে আমাদের সম্মিলিত চেতনায় এক অমোঘ চিহ্ন রেখে যায়। তেমনই একটি গল্প মহারানী পদ্মাবতী ও জোহরের ঐতিহ্য। সাহস, সম্মান এবং ত্যাগের এই গল্প প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং আমাদের কল্পনাকে মুগ্ধ করে চলেছে।

ভারতীয় ইতিহাসের পাতায় অত্যন্ত সুন্দরী ও সাহসী মহারানী পদ্মাবতী’র উল্লেখ আছে।  রানী পদ্মাবতী রানী পদ্মিনী নামেও পরিচিত।  রানী পদ্মাবতীর পিতা ছিলেন সিংহল প্রদেশের (শ্রীলঙ্কা) রাজা গন্ধর্বসেন।ইতিহাসে রানী পদ্মিনী তার ব্যতিক্রমী সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা এবং বীরত্বের জন্য পরিচিত হলেও, তিনি করুণা এবং শক্তির প্রতীক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। দিল্লির শক্তিশালী শাসক আলাউদ্দিন খিলজি তার অতুলনীয় সৌন্দর্যের কথা শুনে তাকে অধিকার করার সংকল্প করেছিলেন।

মহারানী পদ্মাবতী উদয়পুরে এই স্থানে গ্রীস্মকালে থাকতেন ছবি সৌজন্য – উত্তরাপথ

এর অঙ্গ হিসাবে খিলজি চিতোরগড় দুর্গ অবরোধ করেন এবং রাজা রতন সিংকে বার্তা পাঠান যে তিনি রাণী পদ্মাবতীর সঙ্গে দেখা করতে চান।  তাদের সঙ্গে দেখা করে তিনি সেখান থেকে চলে যাবেন। রতন সিং-এর প্রাসাদে পৌঁছেও খিলজি রানীর মুখ দেখতে পাননি।  কারণ রাজপুত প্রথা অনুযায়ী সেইসময় রানীরা অপরিচিত কাউকে মুখ দেখাতেননা পর্দানশীন থাকতেন।এটি জেনেও খিলজি রতন সিংকে অনুরোধ করেন যে তিনি রানীকে দেখতে চান কিন্তু রানী তা প্রত্যাখ্যান করেন।  রতন সিং রানীকে বুঝিয়ে দিলেন যে খিলজি অনেক বড় সাম্রাজ্যের সুলতান।  তাকে অস্বীকার করা ঠিক হবে না।  সব জেনে রানী রাজি হলেন কিন্তু রানী শর্ত দিলেন যে খিলজি তাকে আয়নায় দেখতে পাবে এবং তাও রতন সিং ও কিছু দাসীর সামনে।খিলজি এই শর্ত মেনে নেন।

মহারানী পদ্মাবতীর জহরের প্রতিকী ছবি।

আয়নায় মহারানী পদ্মাবতীকে দেখার সাথে সাথে খিলজি রানীর প্রেমে পড়েন এবং তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যান, এরপর একই দিনে তিনি তার সৈন্যদের সহায়তায় রাজা রতন সিংকে প্রতারণার মাধ্যমে বন্দী করেন।রাজার বিনিময়ে রানী পদ্মিনীর দাবি জানাতে থাকে।এরপর মহারানী পদ্মাবতী শর্ত দেন সুলতানকে সেই মত পরের দিন, ভোরবেলা, ১৫০টি পালকি দুর্গ থেকে খিলজির শিবিরের দিকে রওনা হয়।  রতন সিংকে যেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেখানে পালকি থামল।  পালকিগুলো দেখে রতন সিং ভাবলেন, ওই পালকিগুলো দুর্গ থেকে এসেছে এবং রাণীও নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে এখানে এসেছেন। তখন রাজা নিজেকে খুব অপমানিত বোধ করতে থাকে। এরপর রাজা দেখেন পালকিতে রাণী বা দাসী কেউই নেই। সশস্ত্র সৈন্যরা পালকির মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে রতন সিংকে মুক্ত করে । এরপর আলাউদ্দিনের সৈন্যদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে রতন সিং নিহত হন।  এই তথ্য পাওয়ার পর রানী পদ্মাবতী ভাবলেন যে এখন সুলতানের বাহিনী চিতোরের সমস্ত পুরুষকে হত্যা করবে, তখন চিতোরের মহিলাদের কাছে দুটিই পথ থাকবে, হয় জওহরের প্রতি অঙ্গীকার করা অথবা বিজয়ী বাহিনীর সামনে তাদের অপমান সহ্য করা।

কথিত আছে মহারাণী পদ্মাবতী এই শিব মন্দিরে পূজা করতেন । ছবি সৌজন্যে – উত্তরাপথ

রানী প্রথম পথটি গ্রহণ করেন । জওহর হল একটি রাজপুত প্রথা যেখানে মহিলারা, শত্রু বাহিনীর দ্বারা বন্দী এবং অসম্মানের সম্ভাবনার মুখোমুখি হলে, আত্মসমর্পণ করার পরিবর্তে একটি চিতায় আত্মাহুতি দেবার পথ বেছে নেয়। এটি চূড়ান্ত আত্মত্যাগের একটি কাজ, যা গভীর সম্মানের অনুভূতি এবং তাদের সতীত্ব ও মর্যাদা রক্ষার আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত হয়।

মহারাণী পদ্মাবতী রাজ্যের অন্যান্য মহিলাদের সাথে জোহর করার বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।কথিত আছে সেই সময় তিনি ২৫০০০ দাসী সহ মহলের অন্যান্য স্ত্রীলোকদের সঙ্গে নিয়ে   জওহর পালন করেছিলেন।এই কাজটি পরাজয়ের একটি কাজ ছিল না, বরং তাদের নিপীড়ন করতে চাওয়া শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি প্রতিবাদী বক্তব্য ছিল। এটি ছিল অটুট সাহসের প্রদর্শন করে, তাদের সম্মান রক্ষা করা এবং তাদের রাজ্যের উত্তরাধিকার রক্ষা করা।

মহারানী পদ্মাবতীর গল্প এবং জোওহরের ঐতিহ্য আমাদের সাথে অনুরণিত হয় কারণ এটি নীতি ও মূল্যবোধের গুরুত্ব তুলে ধরে যা ব্যক্তিজীবনকে অতিক্রম করে। এটি ত্যাগের শক্তি এবং চরিত্রের শক্তির কথা বলে যা প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।তবে গল্পটির সূক্ষ্মতা এবং সংবেদনশীলতার সাথে বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও জোহরের কাজটিকে রাজপুত সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগের একটি কাজ হিসাবে দেখা হয়, তবে এটি মনে রাখা অপরিহার্য যে এটি একটি ঐতিহাসিক অনুশীলন যা মহিলাদের স্বায়ত্তশাসন এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। লিঙ্গ সমতা এবং ব্যক্তি পছন্দ প্রচার করার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সম্মান করা গুরুত্বপূর্ণ।আজ, মহারাণী পদ্মাবতীর গল্প এবং জোহরের ঐতিহ্য ইতিহাস জুড়ে নারীদের সম্মান এবং দৃঢ়তার অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে।

ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের দ্বারা চিহ্নিত এতিহাসিক জওহর স্থল। ছবি সৌজন্যে- উত্তরাপথ

মহারাণী পদ্মাবতীর গল্প এবং জওহরের ঐতিহ্য প্রতিকূলতার মুখে নারীদের দ্বারা প্রদর্শিত শক্তি, সাহস এবং ত্যাগের প্রমাণ। এটি মূল্যবোধ এবং নীতির গুরুত্ব তুলে ধরে যা সময়কে অতিক্রম করে  প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে। যদিও সংবেদনশীলতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধার সাথে এই গল্পটি বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।এত বছর পরও এটি আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে থাকা অদম্য চেতনার অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে।

আজও রাজস্থানের চিতর দুর্গে গেলে আমরা সেই স্থানটি দেখতে পাব যেখানে মহারানী পদ্মাবতী জোওহরের ঐতিহ্য পালন করেছিলেন । সেই স্থানটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের দ্বারা চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে।  

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


২০২৩ নির্বাচন কি সত্যি ২০২৪ এর সেমিফাইনাল ?

উত্তরাপথ: ২০২৩ নির্বাচন কি সত্যি ২০২৪ এর সেমিফাইনাল ? না  কি কংগ্রেসের কাছে আবার একটু - একটু  করে ঘুরে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা এবং বিজেপির কাছে মোদী ম্যাজিক যে এখনও অব্যাহত সেটা প্রমান করা। বিজেপির এখন প্রচারের একমাত্র মুখ নরেন্দ্র মোদী। সদ্য সমাপ্ত কর্ণাটক নির্বাচনের পুরো প্রচার হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কেন্দ্র করে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, বিজেপির জাতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা সহ মুখ্যমন্ত্রী বাসভরাজ বোমাই নিজেও প্রধানমন্ত্রী মোদির নামে ভোট চাইলেন। তার  উপরে, প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে .....বিস্তারিত পড়ুন

শালডিহা কলেজের ছাত্রীদের জন্য বিশেষ সার্টিফিকেট কোর্স

উত্তরাপথঃ বাঁকুড়া জেলার শালডিহা কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডঃ সমীর কুমার মণ্ডল এর উদ্যোগে এবং Mahindra Group - এর Mahindra Pride Classroom ও Naandi Foundation -এর যৌথ উদ্দগ্যে শুধু মাত্র ছাত্রীদের জন্য ৭ দিনের (৪০ ঘন্টা) একটি সার্টিফিকেট course -এর আয়োজন করা হয়েছিল। বিভিন্ন রকম স্কিল নিয়ে বিশদে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে হল communication skill, soft skill, life skill, presentaion skill ও interview skill ইত্যাদি। Mohindra Educator -এর ভূমিকাই আসেন সরোজ রাই। তিনি মনে করেন, এই জাতীয় প্রশিক্ষণ শালডিহার মতো প্রান্তিক কলেজের মেয়েরা খুবই উপকৃত হবে। কলেজ কর্তৃপক্ষ আশা করে ভবিষ্যতে মাহিন্দ্রা গ্রুপ এই কলেজে ক্যাম্পাসিং এর .....বিস্তারিত পড়ুন

কতো অজানা রে

মৈত্রেয়ী চৌধুরী: ইতিহাস বিষয়ে আলোচনা করতে গেলেই আমাদের মনে যে সব সৌধের প্রসঙ্গ মনে আসে তারমধ্যে পার্লামেন্ট ভবন একটা অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান। বহু পর্যটক এই ভবন দেখতে যান. কিন্তু জানেন কি, এই পার্লামেন্ট ভবনের ডিজাইন কে বানিয়েছিলেন ? 10 জনকে জিজ্ঞেস করলে 9 জনই বলতে পারবেন না। যাঁরা খুব ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন অথবা গুগুল সার্চ করে থাকেন, তাঁরা হয়তো উত্তরটা দিতে পারবেন। পার্লামেন্ট ভবনের ডিজাইন বানিয়েছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি এডুইন লুটিয়েন। তাঁর সহকারী ছিলেন আরেক ব্রিটিশ স্থপতি হার্বার্ট বেকার। 1927 খ্রিস্টাব্দে এই ভবনটির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় এবং ব্রিটিশ .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top