সম্পাদকীয়- আজ ‘রাজনীতি’- শব্দটা বড় লজ্জিত

এবারের লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই অভিমানের সুর শোনা গিয়েছে প্রায় সব দলের টিকিট না পাওয়া সদস্যদের গলায়। গত ১০ মার্চ ব্রিগেডে জন গর্জন সভা থেকে ৪২টি আসনের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে তৃণমূল। তারপরই কেউ প্রকাশ্যে, কেউ অন্দরে রাগ-অভিমানের কথা জানান। রাজ্য সম্পাদক পদ থেকে সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ইস্তফা দেওয়ার পরই স্পষ্ট হয়ে যায়, তালিকা দেখে খুশি নন তিনিও ।অন্যদিকে বাংলায় ৩৮ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে ফেলেছে পদ্ম শিবির বাকি আর মাত্র ৪ টি আসনের প্রার্থীর নাম ঘোষণা। তালিকায় নিজের নাম না দেখে  রুদ্রনীল ঘোষ সম্প্রতি বিজেপির বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা ৬৭টি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ থেকেও বেরিয়ে গিয়েছেন। তারপর থেকেই তাঁর প্রার্থী তালিকায় ঠাঁই না পাওয়া নিয়ে নানা জল্পনা ছড়িয়েছেন। রাখঢাক না রেখে অভিমানের কথা প্রকাশ্যেও বলেছেন তিনি। রুদ্রনীলের কথায়, “যদি প্রার্থী তালিকার কথা বলেন, বলব একটু তো মন খারাপ হয়েছেই। আমি অভিমানী, বিক্ষুব্ধ এমনটা নয়।”

বর্তমান রাজনীতিতে এমন উদাহরণ অজস্র। আজ ‘রাজনীতি’- শব্দটা বড় লজ্জিত। আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে মানুষ যে ন্যায়, নীতি, আদর্শ নিয়ে রাজনীতির মঞ্চে আসতেন এবং দেশের মানুষের সেবা করার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতেন, আজ তার বড্ড অভাব। কোথায় নীতি, কোথায় আদর্শ, কোথায় গেল জনহিতের চিন্তাভাবনা? রাজনীতির মঞ্চে পুরোটাই এখন দুর্নীতি আর ব্যক্তিস্বার্থে ভরা।

আরও খোলসা করে বললে, রাজনীতি এখন একটা ব্যবসা। বিনা শিক্ষা-দীক্ষা, বিনা পুঁজিতে প্রচুর রোজগারের একটা পথ। এটা জানেন না এমন লোক অন্তত আমাদের দেশ মেলা ভার। আজ একজন সফল রাজনীতিবিদ হলেন তিনি যিনি তার দলকে শক্তিশালী করতে পারবেন, জনসাধারণকে নয়। আজ কৃষক ও নারীদের দুর্দশা ও আত্মহত্যা নেতাদের লজ্জিত করেনা, কারণ তারা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ভান করতে ব্যস্ত। জনগণের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার কথা ভুলে যান, এমন কথা বলাও অর্থহীন। এমতাবস্থায় রাজধর্ম কে পাত্তা দেবে?

এখন রাজনীতিতে এসে নিজের নামের সাথে দলীয় একটি পদ জুড়তে অর্থাৎ অঞ্চল থেকে ব্লক, জেলা কমিটির পদ পেতে  লক্ষ লক্ষ টাকা দাদা-দিদিদের উপঢৌকন দিতে হয়। শুধু কি তাই, নির্বাচনে প্রার্থীতালিকায় নাম তুলতেও প্রচুর টাকার খেলা হয়। নিজের জেলা হোক বা প্রদেশ, সেটিং করতে না পারলে পঞ্চায়েত, পুরসভা কোনও ভোটেই দলের টিকিট জুটবে না।

যে নেতা বা নেত্রী লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে দলের পদ হোক বা জনপ্রতিনিধি হতে টিকিট কিনছেন, তিনি ক্ষমতা পেলে সেই টাকা সুদে-আসলে তুলতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। আর তাই দিকে দিকে এখন তোলাবাজি, দুর্নীতি, সরকারি জমি বিক্রির মতো সিন্ডিকেটের ছড়াছড়ি। আর্থিক সুবিধা আদায়, ধান্দাবাজি ছাড়া রাজনীতির ময়দানে আছেটা কী?

আমাদের দেশে দল এবং সরকারি পদকে ব্যবহার করে ছাত্র, যুব থেকে শুরু করে দলীয় সংগঠনের বেশিরভাগ নেতার সকাল থেকে রাত একটাই লক্ষ্য, টাকা রোজগার। তা সে বেআইনি নির্মাণে মদত দিয়ে হউক, প্রোমোটার বা বড় ব্যবসায়ীকে হুমকি দিয়ে অথবা রিকভারি এজেন্ট হিসাবে কমিশনের মাধ্যমে আয়।বর্তমানে সরকারি চাকুরিহীন রাজ্যে এটি একটি রোজগারের প্রতিষ্ঠিত মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ এই সব যুবক- যুবতীদের পিতা-মাতারাও সন্তানদের নতুন এই পেশার কথা বলতে কুণ্ঠিত বোধ করেননা,বরং তাদেরকে বেশ গর্ভের সাথে বলতে শুনেছি তাদের সন্তান কমিশন এজেন্ট।পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বড় বড় বেসরকারি সংস্থাগুলিকেও সরকারি অফিসের কোটি কোটি টাকার টেন্ডার পেতে নেতাদের সিন্ডিকেটে মাথা ঠুকতে হয়।

সেই সংস্থা যতই অভিজ্ঞ হোক, যোগ্যতা যতই বেশি থাকুক, নেতাদের সিন্ডিকেটে দাবিমতো কমিশন না দিলে কাজ পাবেন না। ইদানীং আবার নেতাদের সিন্ডিকেটই তলে তলে কাজ হাতিয়ে নিচ্ছে। নিরুপায় প্রশাসনেরও চোখ বন্ধ। সিন্ডিকেটে থাকা শাসকদলের নেতা-নেত্রীদের বিশ্বাস, পুলিশ তাদের, প্রশাসন তাদের। হুমকি দিলেও কোনও আইনি পদক্ষেপই হবে না। মিডিয়া জানলে একদিন লিখবে বড়জোর দুদিন লিখবে, তারপর সবাই চুপ। তাই   রাজনীতিবিদেরা রাজনীতি থেকে নীতি কথাটিকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন,এবং রাজনীতিকে একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করে ফেলেছেন ।তাই নির্বাচনে টিকিট পাওয়া নিয়ে চলে মান-অভিমান, ক্ষোভ বিক্ষোভ । আর আমরা সাধারণ জনগণ নির্বাচনের সময় নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলির হাজার হাজার কোটির দুর্নীতির গল্প পড়ি ,উপভোগ করি এবং আসন্ন নির্বাচনে তাদেরকে আবার নির্বাচিত করার জন্য প্রস্তুতি নিই।আধুনিক গণতন্ত্রে আমাদের ভূমিকা এতটাই।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


ওজন হ্রাস (weight loss) মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে

উত্তরাপথঃ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং গোটা শস্য সমৃদ্ধ একটি ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য খাওয়া - এমনকি শুধুমাত্র খাদ্যের নির্দেশিকা অনুসরণ করে   ওজন হ্রাস (weight loss)মস্তিষ্কের বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে ধীর করে বলে মনে করা হয়।সাম্প্রতি ডিউক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত, একটি  গবেষণায় দেখা গেছে যে ওজন হ্রাস মস্তিষ্কে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ৯ মাস পর্যন্ত ধীর করে (aging process) দিতে পারে। গবেষণায় ৬০ থেকে ৭৮ বছর বয়সের মধ্যে ৪৭ জন অংশগ্রহণকারীকে জড়িত করা হয়েছিল, যাদের প্রত্যেকেরই ওজন বেশি বা স্থূল ছিল এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যগ্রহণ  ছিল। তাদের এলোমেলোভাবে একটি ক্যালোরি-সীমাবদ্ধ গ্রুপ বা একটি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপে বরাদ্দ করা হয়েছিল।ক্যালোরি-সীমাবদ্ধতা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি খাদ্য পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যার লক্ষ্য ছিল তাদের আনুমানিক প্রয়োজনের চেয়ে ১০ – ১৫% কম ক্যালোরি গ্রহণ করা। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ গ্রুপ তাদের খাদ্য পরিবর্তন করেনি .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি

আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

রাতের ঘামের সমস্যা এবং এ সম্পর্কে আপনি কি করতে পারেন  

উত্তরাপথঃ রাতের ঘামের সমস্যা শরীরের কুলিং সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক অংশ, তাপ মুক্তি এবং সর্বোত্তম শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।তবে রাতের ঘাম একটি সাধারণ সমস্যা যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।এর  অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য ঘুম ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি রাতে অতিরিক্ত ঘাম অনুভব করেন, তাহলে তার অন্তর্নিহিত কারণটি চিহ্নিত করা এবং এটি মোকাবেলার জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাতের ঘামের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হল।মেনোপজ: যে কেউ, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে, রাতের ঘাম অনুভব করতে পারে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top