সুন্দরবনফাইলস

অসীম পাঠক

রহস্যজনক ভাবে দু সপ্তাহের মধ্যে চারজন মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেলো সুন্দর বন উপকূলের গোপালকাটা গ্রাম থেকে। পুলিশি তদন্ত শুরুর পর দুদিনের মধ্যে নিরাপত্তা র ঘেরাটোপেও পার্শ্ববর্তী বড়ো গ্রাম চিমটা থেকে নিখোঁজ সর্দার অনীশ মাঝি এবং টগর মাঝি, ছোটমোল্লাখালি পুলিশ স্টেশনেও আতংক। তবে কি মানুষ খেকো বাঘের আবির্ভাব হলো, ছয় জন জলজ্যান্ত মানুষ। কে কিভাবে তাদের মারলো? আরণ্যক পটভূমিতে রহস্য ঘনীভূত হয়ে ওঠে। সহজ সরল কৃষিজীবী মানুষ গুলো ভয় খেয়ে যায় …. জংগলে মধু সংগ্রহের ক্ষেত্রে ও বাধা পড়ে। প্রতিকূল পরিস্থিতি তে বেঁচে থাকা মানুষ গুলোর চোখে মুখে ভয়ের সুস্পষ্ট ছাপ চোখে পড়ে। ফরেষ্ট অফিসার রা বাঘের পায়ের কোন চিহ্ন খুঁজে পায়না। সুন্দর বন এলাকার প্রভাবশালী মাতব্বর অনিকেত মাঝির তৎপরতা য় চারিদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। বাঘের পেটে মানুষ গুলো গেলেও কোনো গর্জন কোন চিহ্ন কেন মিলছে না, পুলিশ প্রশাসন আর সাংবাদিকদের ভিড়ে চেনা সুন্দরবন অচেনা হয়ে ওঠে। আরণ্যক প্রকৃতির মোহ মায়ায় কিসের ক্রুরতা? সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাতে না ঘনাতেই নিঝুম সুন্দরবনে ঝিঁঝি পোকার ডাক বিষাক্ত সাপের হিসহিস আর পরিযায়ী পাখীর কিচিরমিচির ছাড়া আর কিছু শুনতে পাওয়া যায় না। তবে মাঝে মাঝে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ডাক ভেসে আসে …. এর ই মাঝে কুড়ি বছরের তাজা ছেলে নয়ন দোলুই কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু নয়নের মা বলে রাতের বেলা কারা নাকি নয়নের কাছে আসতো কদিন ধরে। এরপরই জগা দোলুই এর মা মরা ষোড়শী মেয়ে ফুলমতী সাঁঝের বেলা জল আনতে গিয়ে আর ফেরেনা। আট টা মানুষ হারিয়ে গেলো। পুলিশ কুল কিনারা করতে পারে ণা। দিল্লী থেকে সাত সদস্যের বিশেষ গোয়েন্দা দল আসে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল তুষার সান্যাল এর নেতৃত্বে। সামরিক বাহিনী দিয়ে মুড়ে ফেলা অরণ্য সুন্দরী সুন্দরবন কে। তুষার বাবু পাকা শিকারী একজন। আর্মি তে থাকার সময় থেকেই তাঁর বন্দুকের নিশানা অব্যর্থ … ফরেস্ট অফিসার দের সাথে বৈঠক সেরেই নিখোঁজ দের বাড়িতে যান। পরিবারের সাথে কথা বলেন। স্থানীয় ওসি জগন্নাথ বসু মধ্য চল্লিশের ছিপছিপে চেহারার চটপটে মানুষ , তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দল আসার পর থেকেই বাঘের ডাক বেড়েছে, তুষার বাবুর তদন্তে উঠে আসে নতুন তথ্য চিমটা গ্রামের পাশে আগাছা র জঙ্গলে জোলো জায়গায় কয়েকটি পায়ের ছাপ বাঘের। কিন্তু গরাণ গাছের নীচে বালির স্তুপে মানুষের ছাপ … অথচ এই কয়েকদিনে কেও নিখোঁজ হয় নি। নিখোঁজ নয়নের বাড়ি থেকে বেরোয় বাংলাদেশ কয়েকটি দুশো টাকার নোট। আর ব্ল্যাক ডগ হুইস্কির বোতল, নয়নের মা বলে বেশ কিছুদিন ধরে নয়ন নেশা করতে শুরু করেছিলো। ওসি জগন্নাথ বাবু বলেন তাঁর তদন্তে নয়ন শিক্ষিত ছেলে বেশ মাতব্বর গোছের ছিলো, তবে প্রশ্ন এতো দামী মদের যোগান কে দেয় ? বা হঠাৎ করে তার এই চারিত্রিক পরিবর্তনের কথা তিনি জানতেন না। রহস্য মোড় নেয় অন্যদিকে যখন ফরেষ্ট অফিসার রমনী তালুকদার প্রমাণ করেণ বাঘের পায়ের ছাপ নকল, আর বাঘের গর্জন ও অরিজিনাল নয়। তুষার বাবু চোরাচালানকারী চক্রের গন্ধ পান, সব কিছুই কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কিন্তু মানুষ গুলো কোথায় যাচ্ছে , আর এসবের মাষ্টার মাইন্ডই বা কে ???
তদন্ত জোরালো চলাকালীন নিখোঁজ হলো গজেন দোলুই। এলাকার সন্দেহ ভাজন ক্রিমিনাল দের আটক করা হলো, তুষার বাবু এপার বাংলা ওপার বাংলার সীমান্তে কড়া নজরদারি শুরু করলেন।এমনিতেই সীমান্ত অনুপ্রবেশ নিয়ে চরম জটিলতা …. সীমান্ত মানেই চোরাচালান কারীদের স্বর্গরাজ্য। ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে গোরুপাচার নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকে। তুষার বাবু বাংলাদেশ সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন। সীমান্ত উত্তেজনায় যারা মদত দেয় দুই দেশের তাদের লিস্ট তৈরি হলো। নিখোঁজ গজেন দোলুই এর ঘর সার্চ করে পাওয়া যায় তার খাটিয়ায় গোবুরের দাগ …. অথচ তার ঘরে গোরু নেই। তুষার বাবুর নির্দেশে তার ঘরের বিশ হাত দূরে নিম গাছের নীচে গোবুরের স্তূপে তল্লাশি চলে, বেরিয়ে আসে টেপরেকর্ডার। ও তাহলে এখান থেকেই বাঘের ডাক শোনানো হতো। চিরুনি তল্লাশি চলে গজেন দোলুই এর ঘর জুড়ে। তার কাছে একমাস ধরে কে কে আসতো কার কার সাথে গজেনের যোগাযোগ ছিলো , নয়ন এবং গজেন দুজনই অপরাধের সাথে যুক্ত। তাদের সাথে কার কার নিত্য যোগাযোগ এবং দুজনের কমন যোগ আছে এমন কিছু মানুষ কে চিহ্নিত করণের কাজ শুরু হলো।
গজেন ও নয়ন দুজনের ঘনিষ্ঠ শম্ভু দোলুইকে জেরার কাজ শুরু করেণ তুষার বাবু। শম্ভু এর আগে বে আইনী গাছ কাটার অভিযোগ এ সাতদিন পুলিশ হেফাজতে ছিলো। শম্ভু কে টর্চার করে বেরোয় ফরেষ্ট অফিসের সিনিয়র গার্ড গুরুপদ সরখেলের নাম।টোপ ফেলা হলো গুরুপদ সরখেল কে, তার ফোন কল ঘেঁটে বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য। সুন্দরবন অঞ্চলের প্রভাবশালী নেতা রামনাথ গরাইয়ের দিকে সন্দেহ মোড় নেয়। রামনাথ গরাই কে জালে ফেলার ছক তৈরি করেণ তুষার বাবু। তিনি রটিয়ে দেন পুলিশ ঘটনার তদন্তের স্বার্থে শম্ভু কে দিল্লিতে নিয়ে যাবে , ঠিক দুদিন পর রবিবার রাত্রে। এবং শম্ভু রাজস্বাক্ষী হতে রাজী হয়েছে। শম্ভু কে শেষ করার চক্রান্ত যাতে শুরু করে রামনাথ প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে। কিন্তু রামনাথ সেই টোপ গিললো না। রটিয়ে দেওয়া হয় শম্ভু অসুস্থ… সুন্দরবন প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি। তবুও রামনাথ নীরব। তুষার বাবু বোঝেন রামনাথ একা নয় রামনাথের সঙ্গী আছে। আরও কঠোর হয়ে ওঠেন তুষার বাবু, তিনি শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করেণ। রামনাথের বাড়িতে হানা দেয় তুষার বাবু। রামনাথ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, তুষার বাবু রাজনৈতিক বাধা মানেন না। আর্মির লোক।আইন নিজের হাতে তুলে নেন। গাঁজা কেসে ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে রামনাথ কে এনে তোলেন থানার পরিবর্তে একটা নির্জন জায়গায়। ফিজিক্যাল টর্চারে মুখ খোলে রামনাথ। বেরিয়ে আসে কোলকাতার গুরুপদ মুখার্জি এবং বাংলাদেশের কুখ্যাত স্মাগলার রজ্জাক আলীর নাম। গুরুপদ মুখার্জি বিখ্যাত বিজনেস ম্যান। ভারত বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে এদের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হলো। নোয়াখালী থেকে গ্রেপ্তার হলো রজ্জাক আলী। গুরুপদ মুখার্জির আদি বাড়ি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ডায়মন্ড হারবার। সন্ত্রাসবাদী আর চোরাচালান কারীদের কোন জাত হয় না। এরা মানবতার শত্রু। যখন ভারত বাংলাদেশ মিত্রতা র বন্ধনে আবদ্ধ , সংস্কৃতির মিলনমেলায় দুই দেশের পূর্ণতা পরিলক্ষিত ,,, তখন এইসব গুরুপদ আর রজ্জাক এর মতো মানুষ ,মানুষ নিয়ে ব্যাবসা য় উন্মত্ত। পুরো জাল টা দুজনেরই । ঘটনায় জড়িত মোট পনেরোজন দুষ্কৃতী কে গ্রেপ্তার করা হয় অত্যন্ত দ্রুত।

তদন্তের শেষ পর্যায়ে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গজেন ও নয়ন কে দিয়ে এইসব মানুষ দের গোপন ডেরায় তোলা হতো। নয়ন লোভের বশবর্তী হয়ে আরও রোজগারের জন্য ব্ল্যাকমেইল করতে চাইলে তাকে খুন করে শম্ভু, পরে গজেন এটা জেনে ফেললে তাকেও খুন করা হয়। কি ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা। বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে ভারত বাংলাদেশ চোরাচালান চক্র সুন্দর বনের এইসব সহজ সরল মানুষ দের চোখ কিডনী এসব পাচার করে মায়ানমার। মানুষের শরীর থেকে এইসব বের করে লাশগুলো কে পুঁতে ফেলা হতো খাড়ি র জংগলে। যেখানে সভ্য সমাজের মানুষরা যেতে পারেনা, সেখানেই চরম বর্বরতা। সমুদ্রের উপর দিয়ে চলে অবৈধ জঘন্য এই ব্যাবসা। মানুষের জীবনের কোন দাম নেই এদের কাছে। সুন্দরবনের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে নিষিদ্ধ এক জগতের ছবি। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চেয়েও হিংস্র দুপায়ের জন্তু গুলোকে পুলিশি হেফাজতে দিয়ে কেস কে বাড়ানোর ঝুঁকি নেননা সাহসী অফিসার তুষার বাবু। কর্ণেল তুষার সান্যালের অব্যর্থ নিশানায় এনকাউন্টারে মেরে ফেলেন অপরাধীদের, বারুদের গন্ধে ঢেকে যায় অরণ্য সুন্দরী সুন্দরব।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Vitamin-D: ভিটামিন ডি’র সেবন হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়

উত্তরাপথ: হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক সহ কার্ডিওভাসকুলার রোগগুলি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ।সম্প্রতি একটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা গেছে যে ভিটামিন ডি সম্পূরকগুলি ৬০ বছরের বেশি বয়সী লোকেদের হার্ট অ্যাটাক সহ যে কোনও বড় ধরনের কার্ডিওভাসকুলার অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে পারে৷ গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন ডি প্রায়ই "সানশাইন ভিটামিন" হিসাবে পরিচিত। এটি গ্রহণকারীদের মধ্যে স্ট্রোক সহ কার্ডিওভাসকুলার রোগ ৯% হ্রাস পেয়েছে । যা ২৮ জুন দ্য বিএমজে দ্বারা প্রকাশিত একটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Sustainable Energy: সূর্যের আলো এবং বায়ু,থেকে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড-ব্রেকিং বৃদ্ধি

উত্তরাপথ: সম্প্রতি একটি রিপোর্ট সামনে এসেছে তাতে সূর্যের আলো এবং বায়ু,থেকে সারা বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড-ব্রেকিং বৃদ্ধি ১২% উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এই পুনর্নবীকরণযোগ‍্য সম্পদের ব্যবহার আমাদের অ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারের বিকল্পের দিকে ক্রমবর্ধমান বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করছে। সৌর এবং বায়ু শক্তির ব্যবহারের দ্রুত বৃদ্ধি বিভিন্ন কারণ দ্বারা চালিত হয়েছে। প্রথমত, প্রযুক্তির অগ্রগতি পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ এবং সাশ্রয়ী করে তুলেছে। সৌর প্যানেল এবং বায়ু টারবাইনগুলি এখন আগের চেয়ে আরও দক্ষতার সাথে সূর্য এবং বায়ু থেকে শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম, যার ফলে বিশ্বব্যাপী পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধি .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top