সেলিব্রিটি পূজার সংস্কৃতি: কেন আমারা যে কোনও বিষয়ে সেলিব্রিটিরা কি বলছে তার দিকে তাকিয়ে থাকি  

উত্তরাপথঃ ভারত, ১.৩ বিলিয়ন জনসংখ্যার একটি দেশ, এমন একটি দেশ যা তার সংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবমূর্তির জন্য পরিচিত।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ইদানিং বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সেলিব্রিটিদের মতামত আমাদের দেশের অনেক মানুষের জন্য একটি মানদণ্ড হয়ে উঠে। এই সেলিব্রিটি পূজার বিষয়টি যে শুধুমাত্র অদ্ভুত তা নয় বরং সমালোচনামূলক এবং দুর্ভাগ্যজনক । একজন সাধারণ মানুষ নিজেদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে দূরে সরিয়ে রেখে কোনও নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে তার পছন্দের সেলিব্রিটি কি মন্তব্য করছেন তার উপর নির্ভর করে তার মতামত তৈরি করছেন।

সেলিব্রিটি পূজার ঘটনাটি ভারতে অনন্য নয়, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এটি আরও তীব্র হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি সেলিব্রিটিদের প্রভাব বৃদ্ধিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাদের একটি বিশাল অংশের কাছে পৌঁছানোর এবং জনমত গঠন করার সুবিধা করে দিয়েছে। আমাদের দেশে, সেলিব্রিটিদের নিয়ে মানুষের আগ্রহের অন্ত নেই। বহু মানুষ তাদেরকে রোল মডেল হিসাবে দেখেন, এবং তাদের মতামত আগ্রহের সাথে জানতে চান এবং ব্যাপকভাবে তা অনুসরণ করেন।

আমাদের দেশে রাজনীতি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয়ে সেলিব্রিটিদের মতামত চাওয়া হয় । যখনই একটি বিতর্ক বা সংকট দেখা দেয়, তখনই সেলিব্রিটিদের বিষয়টিতে মন্তব্য করতে দেখা যায়, প্রায়শই বিষয়বস্তু সম্পর্কে খুব কম দক্ষতা বা জ্ঞান না থাকা সত্বেও। এটি এমন একটি পরিস্থিতির দিকে আমাদের যুব সমাজকে পরিচালিত করেছে যেখানে একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির মতামতের চেয়ে বেশি সেলিব্রিটিদের মতামত শুনতে মানুষ তাদের আগ্রহ দেখাচ্ছে।

যার সাম্প্রতিক উদাহরণ হল লোকসভা নির্বাচন।  নির্বাচনের সময়, অনেক সেলিব্রিটিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীদের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করতে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গিয়েছিল। অনেক সেলিব্রিটিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে নির্বাচনী লড়ায়েও দেখা গিয়েছিল। এটি সত্য যে সেলিব্রিটিদের তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে , এটিও লক্ষণীয় যে তাদের মতামতগুলি প্রায়শই সাধারণ নাগরিকদের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হয় জনগণের কাছে। সেই কারণে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে সাধারণ প্রার্থীদের থেকে সেলিব্রিটিদের বেশী গুরুত্ব দেয়। এটি অনেক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, কারণ এই সেলিব্রিটিরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ জনগণের সমস্যাগুলি বুঝতে অসমর্থ হন।

আরেকটি ক্ষেত্র যেখানে সেলিব্রিটিদের মতামত চাওয়া হয় তা হল সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয়ে। যখন নারীর অধিকার বা জাতিগত বৈষম্যের মতো বিষয়গুলি নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়, তখন অনেক সেলিব্রিটি তাদের মতামত সেই বিষয় সম্পর্কে সোশ্যাল সাইটে প্রকাশ করেন। প্রাথমিকভাবে এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি ভাল পদক্ষেপ মনে হলেও, এটি স্বীকার করাও গুরুত্বপূর্ণ যে তাদের সর্বদা সমস্ত বিষয়ে মতামত প্রদানের মত দক্ষতা বা বোঝার ক্ষমতা নাও থাকতে পারে।

সুতরাং সেলিব্রিটিদের মতামতের উপর নির্ভরতা না করে একজন ব্যক্তিকে নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার ভিত্তিতে কোনও বিষয়ে  তার একক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।সম্প্রতি কলকাতায় আর জি করের ঘটনা প্রমান করে দিল দিন বদলাচ্ছে।সাধারণ মানুষ আর সেলিব্রিটিদের মতামতের দ্বারা চালিত হয়ে নিজের সিদ্ধান্ত তৈরি করবে না।সাধারণ মানুষের এই চিন্তাভাবনা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে আমাদের বিদ্যমান সেলিব্রিটি পূজার সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে।

একজন নাগরিক হিসাবে সেলিব্রিটিদের নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করার নিশ্চয় অধিকার রয়েছে তবে সেটা অন্য একজন সাধারণ নাগরিকের মত। যেদিন একজন সাধারণ নাগরিক তার পছন্দের সেলিব্রিটি তার নিজের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কি বলল সেই বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তাকে নিয়ে অযথা সময় নষ্ট না করে তাকে একজন নাগরিক হিসাবে ভাববে, যার নিজের মত প্রকাশের অধিকার আছে। যে দিন আমরা এতদিন ধরে সমাজে চলতে থাকা সেলিব্রিটি পূজার সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে পারব এবং একজন সাধারণ নাগরিকের মতামতও সমান গুরুত্ব পাবে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


মিশন ইম্পসিবল ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান রিভিউ: ৬১ বছর বয়সী টম ক্রুজের আবারও অনবদ্য

উত্তরাপথঃ মিশন ইম্পসিবল দর্শকদের একটি রোমাঞ্চকর যাত্রায় নিয়ে যায়। যেখানে সিনেমাটি  তিন ঘণ্টা দেখা অতিক্রান্ত হওয়ার পরও দর্শক এটি দেখতে চান। আর এটিই টম ক্রুজ এবং পরিচালক ক্রিস্টোফার ম্যাককোয়ারির আসল সাফল্য।গত বছর হলিউড সুপারস্টার টম ক্রুজ 'টপ গান ম্যাভেরিক' দিয়ে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করার পর, এখন টম ক্রুজ এজেন্ট হান্টের চরিত্রে শক্তিশালী অ্যাকশন নিয়ে দর্শকদের সামনে এসেছেন। টম ক্রুজের 'মিশন ইম্পসিবল' ফিল্ম সিরিজের সপ্তম কিস্তি 'মিশন ইম্পসিবল- ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান' সদ্য ভারতে মুক্তি পেয়েছে । টম ক্রুজ এই ছবিতে তার জনপ্রিয় ইমেজ ধরে রেখেছেন এবং এই ছবিতে দর্শকদের অ্যাকশনের একটি বড় অংশ উপহার দিয়েছেন। মিশন ইম্পসিবল মুভিগুলি শুধুমাত্র টম ক্রুজের জন্য দেখা হয় এবং এই মুভিটি দেখা আবশ্যকও বটে৷ .....বিস্তারিত পড়ুন

Diabetes Treatment: রক্তে শর্করা স্থিতিশীল করতে ডালিয়া ফুলের নির্যাস কার্যকর

উত্তরাপথঃ ডায়াবেটিস নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।সম্প্রতি গবেষণায় ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Otago)নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা ক্লিনিকাল ট্রায়ালের মাধ্যমে আবিষ্কার করেছে যে ডালিয়া ফুলের পাপড়ির নির্যাস ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তে শর্করা স্থিতিশীল করতে সাহায্য করতে পারে। সেন্টার ফর নিউরোএন্ডোক্রিনোলজির একজন সহযোগী অধ্যাপক আলেকজান্ডার টুপসের( Alexander Tups) নির্দেশনায়, দলটি খুঁজে পেয়েছে যে, উদ্ভিদের একটি অণু, যা মস্তিষ্কে কাজ করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রন করার জন্য শরীরের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে।প্রসঙ্গত ডায়াবেটিস হল একটি দীর্ঘস্থায়ী বিপাকীয় ব্যাধি যা অপর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদনের কারণে রক্তে শর্করার মাত্রা অত্যাধিক বেড়ে যায়। .....বিস্তারিত পড়ুন

ধানের সাধ ভক্ষণ : জিহুড়

ড.  নিমাইকৃষ্ণ মাহাত: আশ্বিন সংক্রান্তিতে কৃষক সমাজের মধ্যে জিহুড় পার্বণ পালিত হয়। কৃষক সাধারণের মধ্যে জিহুড় পার্বণের একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। জিহুড় অর্থাৎ আশ্বিন সংক্রান্তির সময় বহাল জমিতে লাগানো ধান বা বড়ান ধানে থোড় আসতে শুরু করে। সুতরাং ধান গাছ গর্ভাবস্থায় থাকে। মানুষের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় নানা ধরনের আচার-সংস্কার পালন করা হয়। এই সংস্কারগুলির অন্যতম হলো " ন' মাসি " অর্থাৎ গর্ভাবস্থার নবম মাসে যে আচার -অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এর কিছুদিন পরেই সন্তানজন্মগ্রহণ করে। মানব- সমাজের গর্ভাবস্থাজনিত এই ধরনের আচার সংস্কারের সঙ্গে ধান গাছের গর্ভাবস্থার কারণে পালনীয় অনুষ্ঠান জিহুড়ের সাদৃশ্য থাকে দেখা যায়। সেই জন্য অনেকে জিহুড় অনুষ্ঠানকে ধান গাছের 'সাধভক্ষণ'  বলে থাকেন। জিহুড়-এ ধান গাছ .....বিস্তারিত পড়ুন

মহারানী পদ্মাবতী এবং জোহরের ঐতিহ্য: সাহস ও আত্মত্যাগের এক গল্প

উত্তরাপথঃ ভারতের ইতিহাসে, এমন অনেক গল্প রয়েছে যা সময়কে অতিক্রম করে আমাদের সম্মিলিত চেতনায় এক অমোঘ চিহ্ন রেখে যায়। তেমনই একটি গল্প মহারানী পদ্মাবতী ও জোহরের ঐতিহ্য। সাহস, সম্মান এবং ত্যাগের এই গল্প প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং আমাদের কল্পনাকে মুগ্ধ করে চলেছে।ভারতীয় ইতিহাসের পাতায় অত্যন্ত সুন্দরী ও সাহসী মহারানী পদ্মাবতী'র উল্লেখ আছে।  রানী পদ্মাবতী রানী পদ্মিনী নামেও পরিচিত।  রানী পদ্মাবতীর পিতা ছিলেন সিংহল প্রদেশের (শ্রীলঙ্কা) রাজা গন্ধর্বসেন।ইতিহাসে রানী পদ্মিনী তার ব্যতিক্রমী সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা এবং বীরত্বের জন্য পরিচিত হলেও, তিনি করুণা এবং শক্তির প্রতীক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। দিল্লির শক্তিশালী শাসক আলাউদ্দিন খিলজি তার অতুলনীয় সৌন্দর্যের কথা শুনে তাকে অধিকার করার সংকল্প করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top