আইনস্টাইনের পারমাণবিক বোমা সম্পর্কিত চিঠি জাপানে নিলামে বিক্রি হল না

ছবি – এক্স হ্যান্ডেল থেকে নেওয়া

উত্তরাপথঃ এক সময়ের পরমাণু যুগের ‘ঈশ্বর’ হিসেবে বিবেচিত আলবার্ট আইনস্টাইনের পারমাণবিক বোমার ভয়াবহ শক্তি এবং তার সৃষ্টিতে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ্য চিন্তাভাবনা সম্বলিত একটি ঐতিহাসিক চিঠি সম্প্রতি জাপানের একটি নিলামে বিক্রির জন্য তোলা হলেও, শেষ পর্যন্ত তার কোনো ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বনহ্যামসের তালিকা অনুযায়ী, এই পাঁচ-অনুচ্ছেদের টাইপ করা চিঠির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০০,০০০ থেকে ১৫০,০০০ মার্কিন ডলার। এই চিঠিটি এক সময়কার জাপানি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন Kaijo-তে ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং এটিই ছিল আইনস্টাইনের সবচেয়ে বিশদ ও খোলামেলা প্রতিক্রিয়া তার পরমাণু বোমা সংক্রান্ত ভূমিকা নিয়ে।

পারমাণবিক বোমার ছায়ায় আইনস্টাইনের জীবন

আইনস্টাইন কখনোই সরাসরি পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজে অংশ নেননি, তবে তাঁর পদার্থবিজ্ঞানের বিপ্লবী আবিষ্কারগুলি পারমাণবিক শক্তির প্রযুক্তি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তিনি জানতেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হতে হলে নাজি জার্মানির আগে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দৌড়ে এগিয়ে থাকতে হবে। এই জরুরি পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে ১৯৩৯ সালে তাঁর সহকর্মী পদার্থবিজ্ঞানী লিও সিলার্ডের লেখা একটি চিঠিতে আইনস্টাইন স্বাক্ষর করেন, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের কাছে পাঠানো হয়। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “পরিস্থিতির কিছু দিক সতর্কতা এবং প্রয়োজনে প্রশাসনের তরফে দ্রুত পদক্ষেপের দাবি রাখে। তাই আমি এই তথ্য এবং সুপারিশগুলি আপনার নজরে আনাকে আমার কর্তব্য মনে করছি।” এই চিঠি রুজভেল্টকে পারমাণবিক কর্মসূচি অনুমোদনের জন্য প্ররোচিত করেছিল, যার ফল ছয় বছর পর হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে দেখা গিয়েছিল।

এই ট্র্যাজিক ফলাফল আইনস্টাইনকে তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাড়িত করেছিল। ১৯৪৬ সালে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে তাঁকে একটি মাশরুম ক্লাউডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, যার উপরে লেখা ছিল “E=MC²”। পরের বছর নিউজউইক তাঁকে “পারমাণবিক যুগের জনক” হিসেবে আখ্যায়িত করে। তবে আইনস্টাইন বারবার এই অস্ত্র তৈরিতে তাঁর ভূমিকা থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন।

জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক ও কাইজো পত্রিকার প্রশ্ন

১৯৫২ সালে, কাইজোপত্রিকার সম্পাদক কাতসু হারা আইনস্টাইনকে তাঁর ভূমিকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন পাঠান। ১৯২২ সালে জাপানে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হওয়ার পর থেকে আইনস্টাইনের জাপান এবং এই পত্রিকার প্রতি বিশেষ স্নেহ ছিল। তবে এই সম্পর্ক হারাকে সরাসরি প্রশ্ন করতে বাধা দেয়নি: “আপনি পারমাণবিক বোমার বিশাল ধ্বংসাত্মক শক্তি সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও কেন এর উৎপাদনে সহযোগিতা করেছিলেন?”

১৯৫৩ সালে মিত্রবাহিনীর সেন্সরশিপ বিভাগ হিরোশিমা ও নাগাসাকির ছবি প্রদর্শনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়, যা বিশ্বকে এই ভয়াবহতার প্রথম দৃশ্য দিয়েছিল। জাপানের সঙ্গে আইনস্টাইনের সম্পর্ক এবং এই ঘটনা সম্ভবত তাঁকে এই বিষয়ে তাঁর একমাত্র প্রকাশ্য মতামত প্রকাশে সাহায্য করেছিল।

ছবি – এক্স হ্যান্ডেল থেকে নেওয়া

চিঠির বার্তা

আইনস্টাইন তাঁর উত্তরে বলেছিলেন যে তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখেননি, তবে এর ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে তিনি শুরু থেকেই জানতেন। তিনি লিখেছেন, “পারমাণবিক বোমা তৈরিতে আমার অংশগ্রহণ ছিল একটি একক পদক্ষেপ: আমি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলাম। এই চিঠিতে পারমাণবিক বোমা তৈরির সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে বড় আকারের পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়ার লিখেছিলাম।”

তিনি আরও বলেন,”যদিও আমি একজন কট্টর শান্তিবাদী, তবুও এমন কিছু পরিস্থিতিতে আমি বিশ্বাস করি যে শক্তি প্রয়োগ করা উপযুক্ত – বিশেষ করে এমন এক শত্রুর মুখোমুখি হলে যারা আমার এবং আমার জনগণের নিঃশর্ত ধ্বংসের জন্য তৎপর”।

আইনস্টাইন, তার প্রকাশ্য এবং ব্যক্তিগত জীবনে, ১৯৩৯ সালে তার “একক কাজ” কে কখনও ক্ষমা করেননি বলে মনে হয়। তিনি ১৯৫৪ সালের নভেম্বরে, মৃত্যুর এক বছরেরও কম সময় আগে তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন,”আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলাম যখন আমি রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টকে পারমাণবিক বোমা তৈরির সুপারিশ করে চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলাম…” ।

গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা

চিঠির শেষে আইনস্টাইন স্মরণ করেন মহাত্মা গান্ধীকে, যাঁর অহিংস সংগ্রাম এবং অবিচল আত্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি লেখেন: “গান্ধী, আমাদের সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিভা, দেখিয়ে দিয়েছেন যে মানবিক সংকল্প ও নৈতিকতা মিলে কতটা শক্তিশালী হতে পারে।”

বিক্রি না হলেও মূল্য অমূল্য

Bonhams-এর এই নিলামে চিঠিটি শেষ পর্যন্ত বিক্রি না হলেও, এটি শুধু আইনস্টাইনের চিন্তাভাবনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল নয়, বরং এটি বিংশ শতকের বৃহত্তর ইতিহাসের সাক্ষ্য। একজন বিজ্ঞানীর নৈতিক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক চাপ, বিশ্বযুদ্ধের হুমকি ও মানবিকতা—সবই একত্রে মিশে আছে এই পাঁচ প্যারার টাইপ করা চিঠির প্রতিটি লাইনে।


এই ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বিজ্ঞানের শক্তি যেমন বিশাল, তেমনই তার নৈতিক দায়িত্বও বিপুল। আইনস্টাইনের মতপ্রকাশ, নীরব অনুশোচনা এবং মানবিক আহ্বান আজও প্রাসঙ্গিক, বিশেষ করে এক অস্ত্রভিত্তিক বিশ্বে যেখানে যুদ্ধ প্রস্তুতি যেন একটি চিরকালীন বাস্তবতা।

সূত্র: Bonhams Auction Catalog | Kaijo Archives | TIME, 1946 | Newsweek, 1947 | Einstein Diaries, 1954 | Correspondence with Sei Shinohara

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?

প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে  পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি  তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি

আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

সম্পাদকীয়-  রাজনৈতিক সহিংসতা ও আমাদের গণতন্ত্র

সেই দিনগুলো চলে গেছে যখন নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকেও সম্মান করতেন। শাসক দলের নেতারা তাদের বিরোধী দলের নেতাদের কথা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।  আজ রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।  কেউ কারো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়।  আগ্রাসন যেন রাজনীতির অঙ্গ হয়ে গেছে।  রাজনৈতিক কর্মীরা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুন বা মানুষ মারার মত অবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আমাদের দেশে যেন রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে বেশি মানুষ নিহত হচ্ছেন।  ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) অনুসারে, ২০১৪ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা গিয়েছিল।  আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য যে আমাদের সিস্টেমে অনেক মৌলিক সমস্যা রয়েছে যা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড়কে গ্রাস করছে, যার জন্য সময়মতো সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top