তবু মনে রেখো……….‌💥💥

মৈত্রেয়ী চৌধুরী

সোশ্যাল মিডিয়ায় বাজি রাউতের এই ছবিটি আবহমান কাল ধরে ক্ষুদিরামের বলে চালানো হয়েছে। ছবি সংগৃহীত

আশ্বিনের রাতে মৃদুমন্দ বাতাসে নৌকোর ভিতরে চোখ লেগে এসেছিল ১২ বছরের ছেলেটার। আচমকা চাপা চিৎকারে ধড়মড়িয়ে উঠল। সামনে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ সাহেব আর গোরা পল্টন। হুকুম, পার করিয়ে দিতে হবে ব্রাহ্মণী নদী!
কিন্তু সে ছেলে অনড়। হাজারো চোখরাঙানিতে কাজ হল না। অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকদের কাউকে সে নদী পার করিয়ে দেবে না। মুহূর্তের মধ্যে নৌকোতেই লুটিয়ে পড়ল তার নিথর দেহ। প্রথমে মাথায় বেয়োনেটের আঘাত। তারপর বুকে ও মাথায় গুলি। নৌকায় পড়ে রইল ১২ বছরের একটা ছোট্ট দেহ, পরাধীন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ মৃত্যুঞ্জয়ী বীর #বাজি_রাউত। দিনটি ছিলো ১৯৩৮ সালের ১১ই অক্টোবর।

অকালমৃত্যুর দিনকয়েক আগেই ছিল তার জন্মদিন। তবে ‘জন্মদিন’ ঐ নামেই, অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। বাজির মা দিনভর পড়শিদের বাড়িতে ঢেঁকি পাড়তেন। তবেই ঘরে আসত সামান্য খুদকুঁড়ো।

ওড়িশার ঢেঙ্কানল জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ভুবনের এক হতদরিদ্র পরিবারে ১৯২৬ সালে আজকের দিনে #৫ই_অক্টোবর জন্ম হয়েছিল বাজি-র। বাবা ছিলেন নীলকণ্ঠপুর ঘাটের মাঝি। ব্রাহ্মণী নদী পারাপার করত তাঁর নৌকো। পারানি যা পেতেন তাতে স‌ংসারের অভাব দূর হত না। স্ত্রী-সন্তানকে আরও অকূল পাথারে ফেলে চোখ বুজলেন নীলকণ্ঠপুর ঘাটের মাঝি। অপটু হাতে বৈঠা ধরা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকল না বাজির কাছে। শুধু নদীঘাটের নয়, ছোট্ট বাজি-ই হয়ে উঠল সংসারের কান্ডারি।

সে সময় ঢেঙ্কানলের দেশীয় রাজা ছিলেন শঙ্করপ্রতাপ সিংহদেও। তাঁর অত্যাচারে খাজনা যোগান দিতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠত সাধারণ প্রজাদের। ধীরে ধীরে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এলেন কমিউনিস্ট মন্ত্রে দীক্ষিত ঢেঙ্কানলের বৈষ্ণবচরণ পট্টনায়ক। হরমোহন পট্টনায়কের সঙ্গে মিলে তিনি তৈরি করলেন ‘প্রজামণ্ডল আন্দোলন’। তার অংশ হিসেবে এল ‘বানরসেনা’। স্থানীয় বালক ও কিশোরদের নিয়ে তৈরি সেই সংগঠনের কাজ ছিল নজরদারি। সংগঠনের সদস্য ছিল বাজি রাউতও।

আন্দোলনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল শাসকের অত্যাচারও। জারি হল রাজভক্ত কর। যারা দিত না, হাতির পায়ের তলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হত তাঁদের কাঁচাবাড়ি। অত্যাচার আরও নির্মম করতে ঢেঙ্কানলের শাসকের সঙ্গে যোগ দিলেন স্থানীয় আরও কিছু শাসক। কলকাতা থেকে ২৫০ বন্দুকধারী সেনা পাঠাল ব্রিটিশ সরকার। ভুবন গ্রামে শুরু হল পাগলের মতো তল্লাশি। হরমোহন পট্টনায়কের সন্ধানে। ঘরে ঘরে জেরা, তথ্য চাই তাঁর সম্বন্ধে। কিন্তু নির্যাতনের মুখেও গ্রামবাসীদের মুখে কুলুপ। ব্রিটিশদের কাছে খবর ছিল, গ্রামেই লুকিয়ে আছেন হরমোহন। বৈষ্ণবচরণ ছিলেন রেলকর্মী। তিনিও ব্রিটিশদের কাছে অধরা ছিলেন।

ব্রিটিশদের কাছে খবর এল, ব্রাহ্মণী নদী পেরিয়ে পালিয়েছেন হরমোহন। সেইমতো নীলকণ্ঠপুর ঘাটে বাঁধা বাজির নৌকোর কাছে পৌঁছল তারা। বাজির উপর দায়িত্ব ছিল ঘাটের চারপাশে নজরদারি। সে নদী পার করানোর বদলে মৃত্যুবরণ করল। মৃত্যুর আগে শেষ প্রাণবিন্দু অবধি সে চিৎকার করে গ্রামবাসীদের সতর্ক করেছিল, যে নদীর ঘাট অবধি পৌঁছে গিয়েছে ব্রিটিশ সেনা।

বাজির চিৎকারে ভিড় জমতে দেরি হল না। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে আবারও গুলিবৃষ্টি করল ব্রিটিশ সেনা। তাতে মারা যান আরও চারজন। বাজি-সহ সবার দেহ পাঠানো হয়েছিল কটকে। ময়নাতদন্তের পরে কটকের রাস্তায় শোকযাত্রার পরে সম্পন্ন হয়েছিল শেষকৃত্য। হাজারো জনতা সমবেত হয়েছিলেন, বাজি ও বাকি বীরদের শ্রদ্ধা জানাতে।

প্রতি বছর উৎকল দিবসে দেওয়া হয় ‘বাজি রাউত সম্মান’। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভাবান ওড়িশার কিশোরদের দেওয়া হয় এই সম্মান। ইতিহাসের পাতায় ঢুকে পড়ে একটি ১২ বছরের কিশোরের নাম। আজও যখন ব্রাহ্মণীর পাড়ে সূর্য ওঠে, একটি নামেই ছড়ায় তার আলো।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


বেঙ্গালুরুতে বিরোধী জোট গঠনের বৈঠকে অংশ নিতে পারে ৩২টি দল

উত্তরাপথ: আগামী লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বিরোধী জোট গঠনের জন্য বেঙ্গালুরুতে আগামী ১৭-১৮ জুলাই বিরোধী দলগুলির সমাবেশ হতে চলেছে। এই বৈঠকে ২৪টি রাজনৈতিক দল অংশ নেবে বলে জানা গেছে। সূত্রের খবর, এবার বিরোধী দলে যোগ দিতে যাচ্ছে আরও নতুন ৮টি দল। এই দলগুলি হল, মারুমালারচি দ্রাবিড় মুনেন্দ্র কাজগাম, কঙ্গু দেস মক্কাল কাচ্চি, বিদুথালা চিরুথাইগাল কাচ্চি, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল, অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ, কেরালা কংগ্রেস জোসেফ, কেরালা কংগ্রেস মানি ।তবে বিরোধী জোটে যদি সব গুলি দল .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top