বঞ্চনার আর এক নাম শবর

বলরাম মাহাতো

ছবি সৌজন্যে : সবর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট

শবর কথাটির উৎপত্তি হয়েছে ‘সগর’ থেকে।  ‘সগর’ শব্দের অর্থ হলো কুঠার। বোঝাই যাচ্ছে, শবররা কুঠার হাতে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। সেখান থেকেই শবর নামটির প্রচলন হয়। শবররা বাস করেন পশ্চিম বাংলা, চেন্নাই, মধ্যপ্রদেশ, ছোটনাগপুর আর উড়িষ্যায়।  আমাদের দেশে বর্তমানে শবরদের সংখ্যা ২,০০০ এর কিছু বেশি।

শবর কোনো একজনের নাম নয়, এটি একটি জনগোষ্ঠীর নাম। বর্তমানে ভারতে এই শবর জনগোষ্ঠী একটি অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, অবশ্য তাতে শবরদের হাত নেই। জগতের নিয়ম সম্ভবত এমন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা দিনে দিনে আরও বড় হয়, আর সংখ্যালঘুরা দিনকে দিন পড়ে পড়ে মার খায়। শবররা আর দশটা অধিবাসীর মতোই ভারতের অধিবাসী। কিন্তু তাদের ঘিরে রয়েছে অনেক বিতর্ক কারন শবররা যে শুধু ইংরেজদের অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছে তা নয়। তারা নিপীড়িত হয়েছে নিজেদের মানুষদের দ্বারাই। বর্ণবাদী হিন্দু, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী শক্তির সাথে শবরদের লড়তে হচ্ছে প্রতিদিন। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত সরকার তাদের বিমুক্ত জাতি হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি ।অস্পৃশ্য হিসেবে আখ্যায়িত করে শবরদের সমস্ত সামাজিক কার্যক্রম থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। তাই মূল সমাজ থেকে তারা এখন অনেক দূরে। জঙ্গলনির্ভর শবররা এখন বেশিরভাগই কর্মহীন, কেননা গাছ কাটা বেআইনী। তারা বেশিরভাগই কৃষিকাজ বা পশুপালনের কাজ পারেন না। ফলে অধিকাংশই অনাহারে জর্জরিত জীবনযাপন করে। কাগজে-কলমে ভূমিহীন না হলেও বাস্তবে শবরদের নিজেদের কোনো জমি নেই।

শবরদের গ্রামগুলোতে মানুষের জন্মহারের তুলনায় মৃত্যুহার অনেক বেশি। শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৫০ জনেরও বেশি। প্রতি ১,০০০ পুরুষ পিছু নারীর সংখ্যা অনেক বেশি, এমনকি শিশুদের মাঝেও মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চাইতে অনেক বেশী । এর কারণ জৈবিকভাবে কোনো এক বিচিত্র কারণে শবর ছেলেশিশুরা মেয়েদের চেয়ে দুর্বল হয়ে জন্ম নেয়।

আর যেসব শিশুরা বেঁচে থাকে, তারা প্রকারান্তরে আরও অভাগা। দুদিন পর একদিন পেটপুরে খাবার পায় তারা, সারা বছর অপুষ্টি আর অনাহারে ভুগতে থাকে। বাড়ির বড়রা মদের নেশায় পেটের জ্বালা ভুলে থাকতে চায়, কিন্তু শিশুদের সেই সুযোগটা নেই। সামাজিক অক্ষমতা আর অমর্যাদার জন্য শবররা অন্যান্য গোষ্ঠীর চোখেও নীচু। মুন্ডারা শবরদের প্রতিবেশী গোষ্ঠী, কিন্তু তাদের কাছেই হেয় হতে হয় নিত্যদিন। মুন্ডারা বলে, শবরদের যেহেতু জমি নেই, তাই তাদের কোনো সম্মানও নেই।শবররা অস্পৃশ্য বলে তারা কর্মহীন, কর্মহীন বলে ভূমিহীন, আর ভূমিহীন বলে তারা সামাজিক মর্যাদাহীন। তারা বাজারের দিকে যেতে চায় না, হাসপাতালের পথ মাড়ায় না। স্কুলে পড়া তাদের জন্য বিলাসিতা। শবরদের জন্য দেওয়া সরকারি ত্রাণ খরচ না হয়েই ফেরত চলে যায়। শবর-শবরীদের আর্ত চিৎকার শোনার মতো আসলে কেউই নেই। তাদের কথা অনুযায়ী, সরকার টাকা দিয়ে পুলিশ রেখে মারধোর করাতে পারলেও, তাদের উন্নয়নের জন্য কিছুই করছেনা। শবরদের নিয়ে গবেষণা করার পর বেরিয়ে আসে অনেকগুলো ভয়াবহ তথ্য। ২০১৬ সালে ‘ওয়ার্ল্ড জার্নাল অব ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাসিটিউকাল সায়েন্সেস’ জার্নালে শবর ও সাঁওতালদের পুষ্টি বিষয়ক একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়। ৪টি গ্রামের ওপর করা এই সমীক্ষায় জানা যায়, লোধা শবর রমণীদের ৩৩.৩ শতাংশই অপুষ্টিতে ভোগেন। এখানকার মানুষজনের মধ্যে যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, রক্তস্বল্পতা, কলেরা, চর্মরোগ ইত্যাদি লেগেই থাকে। আধুনিক চিকিৎসার চাইতেও ওঝাদের ঝাড়-ফুঁক আর শেকড় বাকড়ের ওপর ভক্তি বেশি তাদের। কারণ গ্রাম থেকে হাসপাতালের দূরত্ব এতই বেশি যে সেখানে নিতে যেতে যেতেই রোগী ইহকাল ত্যাগ করেন। আর যাতায়াতের ভাড়া দেবার সামর্থ্য তো নেই-ই।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে

উত্তরাপথঃ হঠাৎ করেই একটি নতুন দ্বীপের জন্ম হয়েছে।২০২৩ এর ৩০ অক্টোবর  প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একটি মৃত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত একটি নতুন দ্বীপের জন্ম দিয়েছে। বিস্ফোরণের পর জাপানের ওগাসাওয়ারা দ্বীপ চেইনের কাছে বিশাল বিশাল পাথরের টুকরো দেখা গেছে। এ বিষয়ে জাপানি গবেষক বলেন, গত মাসে প্রশান্ত মহাসাগর জলের নিচে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের পর টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইওটো দ্বীপের কাছে একটি ছোট নতুন দ্বীপের উদ্ভব হয়েছে।টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফুকাশি মায়েনো জানিয়েছেন যে নতুন দ্বীপ, এখনও যার নাম নেই প্রশান্ত মহাসাগরের ইওটো দ্বীপ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ১০০ মিটার ব্যাসের একটি পাথুরে দ্বীপে একটি phreatomagmatic বিস্ফোরণ ঘটেছে। টোকিও থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিস্ফোরণটি দেখা গেছে। ভূপৃষ্ঠের নীচে জলের সাথে লাল গরম ম্যাগমা সংঘর্ষের কারণে প্রতি কয়েক মিনিটে বিস্ফোরণ ঘটে।গত ২১ অক্টোবর, ২০২৩-এ অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল, যা আগে ইও জিমা নামে পরিচিত ছিল এবং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্থান ছিল। প্রায় ১০ দিন ধরে অগ্ন্যুৎপাত চলার পর, আগ্নেয়গিরির উপাদান অগভীর সমুদ্রতলের উপর জমা হয় এবং প্রায় ১৬০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় বড় বড় পাথরের আকারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে। .....বিস্তারিত পড়ুন

NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Electoral Bond এর গোপনীয়তা সরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে, জানাতে হবে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ

উত্তরাপথঃ বুধবার, নির্বাচনী বন্ড (Electoral Bond)প্রকল্পের আইনি বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের শুনানি হয়। শীর্ষ আদালত তার মন্তব্যে বলেছে, 'নির্বাচনী বন্ডগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামী অর্থ প্রদান করে, কারণ তাদের কেনাকাটা সম্পর্কিত রেকর্ডগুলি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে উপলব্ধ যা শুধুমাত্র তদন্তকারী সংস্থাগুলি অ্যাক্সেস করতে পারে৷ এর আগে নির্বাচনী বন্ড’ (Electoral Bond) সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) কেন্দ্র দাবি করেছিল, রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের উৎস জানার অধিকার নেই জনতার।এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৎপর হল নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India)।বুধবার বিকেল ৫টার মধ্যে যাবতীয় হিসেব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিশনের তরফে।নির্বাচনী বন্ডের (Electoral Bond)মামলায় কেন্দ্রের আর্জি সত্বেও সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক দলগুলিকে আয়ের উৎস জানাতে বলেছিল। আদলত নির্দেশ দিয়েছিল, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল কত অনুদান মিলেছে, সেই তথ্য বন্ধ খামে জানাতে হবে।এর আগেও নির্বাচনী বন্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাধিক মামলা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। মামলাকারীরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বিদেশ থেকে পেতে পারে এর ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে। যদিও কোনও রাজনৈতিক দলই এই দাবি মানতে চায়নি। ৩ অক্টোবর মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সব তথ্য দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এই রায়ের পরেই তৎপর হল কমিশন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top