“বিস্মৃত” এক বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কথা

রাধাগোবিন্দ চন্দ্র| Digital Art: লেখক

ড. সায়ন বসুঃ রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের নাম জানে বা শুনেছে এমন বাঙালির সংখ্যা হাতে গুনে পাওয়া গেলেও পাওয়া যেতে পারে এমন সম্ভাবনাও কম। এতো কম পরিচিতি যে মানুষটির তিনিই কিনা American Association of Variable Star Observers এর মতো সংস্থার প্রথম আন্তর্জাতিক সদস্য! রবি ঠাকুর থেকে শুরু করে স্টিভ জবস, পৃথিবী জুড়ে যে অসংখ্য সফল মানুষের উদাহরণ রয়েছে যারা তথাকথিত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েও স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধণ্য হয়েছেন তাদের মধ্যে রাধাগোবিন্দ চন্দ্রকে অনায়াসে গোনাই যায়। না হলে কে ভেবেছিলো যে চারবারের চেষ্টাতেও যে তৎকালীন সময়ের মেট্রিক পরীক্ষাতে পাশ করতে পারেনি সেই কিনা প্রায় ৫০,০০০ এর কাছাকাছি variable stars (যে সমস্ত তারার উজ্জ্বলতা সময়ের সাথে বাড়ে বা কমে) ৩ ইঞ্চি আর ৬ ইঞ্চির টেলিস্কোপ দিয়ে দেখে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান মহলে সাড়া ফেলে দেবে!

রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের জন্ম ১৮৭৮ সালের ১৭ জুলাই অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলার বাগচার গ্রামে। তার বাবা গোরাচাঁদ ছিলেন স্থানীয় এক ডাক্তারের কম্পাউন্ডার এবং মা পদ্মমুখ ছিলেন গৃহকত্রী। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে রাধাগোবিন্দ ১০ বছর বয়েসে যশোর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। যদিও এর মধ্যেই কিশোর রাধাগোবিন্দকে রাতের আকাশে খালি চোখে তারা দেখার নেশা পেয়ে বসেছে। স্কুলে ভর্তি হয়ে তিনি বুঝতে পারলেন যে তথাকথিত স্কুল শিক্ষায় তার ঠিক মন বসছে না। ফলস্বরূপ যা হওয়ার তাই হলো। তিনবার পর পর মেট্রিক পরীক্ষায় ফেল করলেন রাধাগোবিন্দ। এরপর ১৮৯৯ সালে ২১ বছর বয়েসে তার বিয়ে হলো মাত্র ৯ বছর বয়সী গোবিন্দ মোহিনীর সাথে (এখানে বলে রাখা উচিত লেখক কোনোমতেই বাল্য বিবাহকে সমর্থন করেন না) এবং পরবর্তীকালে তাদের এক পুত্র (নাম – কাল) এবং এক কন্যা (নাম- বর্ষা) হয়। বিয়ের পর রাধাগোবিন্দ আরোও একবার মেট্রিক পরীক্ষায় বসেন এবং আবার অকৃতকার্য হন। এরপর তিনি স্কুলের পড়াশোনাকে চিরদিনের মতো বিদায় জানিয়ে চাকরির খোঁজে নেমে পড়েন এবং শেষমেশ যশোর জেলার কালেক্টরেট অফিসে খাজাঞ্চির পদে যোগ দেন।

যদিও চাকরির পাশাপাশি তিনি তার তারা দেখার যে আগ্রহ তা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে থাকাকালীন যে বইটি তার মনে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহের জন্ম দেয় সেটি ছিল লেখক অক্ষয় কুমার দত্তের লেখা চারুপথ।  বলে রাখা ভালো যে চাকরির পাশাপাশি তিনি যশোরের একজন নাম করা উকিল কালীনাথ মুখার্জীর কাছে তালিম নিচ্ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের। এই কালীনাথ মুখার্জী নিজে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেশ কিছু বইও লিখেছিলেন। রাধাগোবিন্দ, কালীনাথ মুখার্জীকে গ্রহদের একটি নকশা তৈরী করতে সাহায্যও করেছিলেন। কালীনাথ বাবুর কাছে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার সময়েই তাঁর কৃষ্ণনগর আদালতের এক উকিল এবং সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জে. হার্সেল (J. Harsel) -এর সাথে পরিচয় হয়।

নিজের অতি সামান্য একটি দূরবীন দিয়েই তিনি ১৯১০ সালে হ্যালির ধূমকেতু দেখেছিলেন এবং দু’মাস ধরে তাঁর যে পর্যেবক্ষন তা একটি বাংলা সাময়িক পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। ১৯১২ সালে তিনি একটি ৩-ইঞ্চির টেলিস্কোপ কেনেন ইংল্যান্ড থেকে যার দাম পড়েছিল ১৩ পাউন্ড। ১৯১৮ সালে জুন মাসে তিনি Nova (একটি ল্যাটিন শব্দ যার বাংলা অর্থ – নতুন) Star (একটি ক্ষণস্থায়ী ঘটনা যেখানে হঠাৎ করে আকাশে একটি “নতুন” উজ্জ্বল তারার দেখা মেলে যা পরবর্তী কিছু সপ্তাহ বা মাসের মধ্যে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়) চিহ্নিত করেন এবং নিজেকে প্রথম এশিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী বলে দাবি করেন যিনি এরকম তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন। নোভা তারার যে পর্যবেক্ষণ তার সম্মন্ধে তিনি বিস্তারিত ভাবে লেখেন এবং তা প্রকাশিত হয় “প্রবাসী” পত্রিকায়। পরবর্তীকালে এই তারাটির নাম দেওয়া হয় ‘Nova Aquila-3’। রাধাগোবিন্দ তাঁর যে পর্যবেক্ষণ তা একটি বিবরণের আকারে লিখে পাঠান ড. এডওয়ার্ড পিকেরিংকে যিনি হার্ভার্ড কলেজ মানমন্দিরের অধিকর্তা ছিলেন। তাঁর বিবরণ পড়ে ড. পিকেরিং এতটাই প্রভাবিত হন যে তিনি রাধাগোবিন্দের নাম American Association of Variable Star Observers (AAVSO) এর সদস্য হিসেবে নথিভুক্ত করেন। ১৯২৬ সালে ড. পিকেরিং একটি ৬-ইঞ্চি টেলিস্কোপ রাধাগোবিন্দকে পাঠান যাতে করে তিনি তাঁর পর্যেবেক্ষন আরোও ভালোভাবে চালিয়ে যেতে পারেন তার জন্যে। এই টেলিস্কোপটি এখন দক্ষিণ ভারতের কাভালু স্পেস অব্জারভেটরিতে রাখা আছে। 

তার পর্যবেক্ষণ মূলত ছিল Variable Stars সম্পর্কিত। Variable Stars সেই সমস্ত তারাদের বলা হয় যাদের সাধারণত সময়ের সাথে সাথে উজ্বলতা বাড়ে বা কমে । কিছু Variable Stars -এর উদাহরণ হলো – Mira, Lyra, Algol ইত্যাদি| রাধাগোবিন্দ যে সমস্ত Variable Stars পর্যবেক্ষণ করতেন সেগুলির সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ লিখে পাঠাতেন হার্ভার্ড অব্জারভেটরি (আমেরিকা), ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল আসোসিয়েশন (ইংল্যান্ড), এবং লিঁও অব্জারভেটরিতে (ফ্রান্স)। তার এই পর্যবেক্ষণ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণায় অবদানের কথা মাথায় রেখে ফরাসি সরকার তাঁকে ১৯২৮ সালে `Officer de Academic’ উপাধিতে ভূষিত করেন । ১৯৪৬ সালে American Association of Variable Star Observers (AAVSO) থেকে ২৫ জন বিশিষ্ঠ জ্যোতির্বিদদের একটি তালিকা প্রকাশিত হয় তাঁদের অবদানের জন্যে এবং সেই তালিকাতেও রাধাগোবিন্দের নাম উল্লেখ করা হয় । এখানে বলে রাখা ভালো এই তালিকায় সেই সমস্ত জ্যোতির্বিদদেরই নাম উল্লেখ করা হয় যারা ১০,০০০ এর বেশি Variable Stars, ধূমকেতু ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ১৯১৯ থেকে ১৯৫৪ এই ৩৬ বছরে তিনি মোট ৩৭,১২৫ Variable Stars এর পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এবং তার বিস্তারিত বর্ণনা হার্ভার্ড অব্জারভেটরিতে পাঠিয়েছিলেন।   

 ১৯৫৪ সালে ৭৬ বছর বয়েসে অবশেষে তিনি পর্যবেক্ষণ এর কাজ থেকে অবসর নেন। তিনি কোলকাতাতে একটি জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় ক্লাবও প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর বেশ কিছু বইও তিনি লেখেন। জীবিত থাকাকালীন তাঁর একটি বইই প্রকাশিত হয় যেটির নাম ধূমকেতু ।

১৯৭৫ সালে ৩রা এপ্রিল ৯৭ বছর বয়েসে তিনি মারা যান ।  এই অতি স্বল্পপরিচিত মানুষটি নিজের অতি সামান্য পরিসরের মধ্যে থেকেও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি উপার্জন করেছিলেন তা বোধ তৎকালীন সময়ে বঙ্গসমাজে সে রকমভাবে সমাদৃত হয়নি। কিন্তু আজ বোধ এই ইন্টারনেটের যুগে সেই সময় এসেছে যখন আজকের বঙ্গসমাজ ইচ্ছে করলেই পারে রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের মতো প্রায় হারিয়ে যেতে বসা বাঙালিদের খুঁজে বের করে তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু ফিরিয়ে দিতে।

* লেখক বর্তমানে University of Witwatersrand-এর Centre for Astrophysics-এ কর্মরত রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির গবেষক।

যোগাযোগ- sayan.basu@wits.ac.za

ইচ্ছুক পাঠক-পাঠিকা রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের লেখা ধূমকেতু বইটি পড়তে বা ডাউনলোড করতে পারেন নিচের লিংক ব্যবহার করেঃ

http://125.22.75.155:8080/handle/123456789/10007 

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Fructose: নতুন গবেষণায় ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার কারণ বলা হয়েছে

উত্তরাপথঃ একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জোরালো প্রমাণ দেওয়া হয়েছে যে ফ্রুক্টোজ (Fructose), সাধারণত প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং পানীয়গুলিতে থাকা এক ধরনের চিনি, যা স্থূলতার প্রাথমিক চালক। বছরের পর বছর ধরে, পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা , পাশ্চাত্য খাদ্যে, স্থূলতার মূল কারণ নিয়ে বিতর্ক করেছেন, কেউ কেউ অত্যধিক ক্যালোরি গ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, অন্যরা কার্বোহাইড্রেট বা চর্বি জাতীয় খাবারকে দায়ী করেছেন। Obesity জার্নালে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে ফ্রুক্টোজকে স্থূলতার প্রকৃত চালক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।The University of Colorado Anschutz Medical Campus এর Dr. Richard Johnson এবং তার দলের মতে, ফ্রুক্টোজ হল একটি সাধারণ চিনি যা ফল এবং মধুর প্রাথমিক পুষ্টি। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

World’s most polluted cities: নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়

উত্তরাপথঃ দিওয়ালি উদযাপনের একদিন পর জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় উঠে এসেছে।সোমবার, অর্থাৎ দীপাবলির পরের দিন এই শহরগুলির বায়ুর গুণমান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খারাপ হয়েছে।বায়ুর গুনমান খারাপ হওয়ার পেছনে মাত্রাতিরিক্ত আতশবাজি জ্বালানোকে দায়ী করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় যথারীতি প্রথম স্থান দখল করেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। দীপাবলির পরের দিন এটির AQI (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) পরিসংখ্যান ছিল ৪০৭। নভেম্বরের শুরু থেকে, দিল্লিতে AQI পরিসংখ্যান খারাপ হয়েছে।  সুইস গ্রুপ আইকিউএয়ার শহরের বাতাসকে "বিপজ্জনক" বিভাগে রেখেছে।ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়(World’s most polluted cities), ১৫৭ এর AQI সহ ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। কলকাতা ১৫৪ এর AQI সহ সপ্তম স্থানে রয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top