সাঁওতাল উপজাতি: পশ্চিমবঙ্গের একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

উত্তরাপথ:

পশ্চিমবঙ্গ সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি রাজ্য। রাজ্যটিতে অনেক আদিবাসী উপজাতি রয়েছে এবং তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হল সাঁওতাল উপজাতি। সাঁওতাল উপজাতির একটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ল্যান্ডস্কেপের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাঁওতাল উপজাতিরা তাদের বীরত্বের জন্য পরিচিত । তাঁরা ভারতে বৃটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।  

সাঁওতাল উপজাতি ভারতের উত্তর-পশ্চিমে গঙ্গা উপত্যকা থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়। তারা পরে দেশের পূর্বাঞ্চলে চলে আসে এবং বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, বিহার এবং ওড়িশা রাজ্যে বসতি স্থাপন করে। সাঁওতাল উপজাতি তাদের অনন্য রীতিনীতি, ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসের জন্য পরিচিত, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসছে।

সাঁওতাল উপজাতি প্রধানত একটি কৃষি প্রধান সম্প্রদায়, এবং তারা ঐতিহ্যগত কৃষি পদ্ধতি অনুশীলন করে। তারা ধান, ভুট্টা এবং অন্যান্য ফসল চাষে তাদের দক্ষতার জন্য পরিচিত। সাঁওতাল গ্রামগুলি ঘুরলে দেখা যাবে তাঁরা এক বিশেষ ধরনের বাড়িতে বাস করে । ওলাহ নামে তাদের বাড়িগুলির বাইরের দেয়ালে একটি নির্দিষ্ট তিন রঙের প্যাটার্ন রয়েছে।  নীচের অংশটি কালো মাটি দিয়ে আঁকা হয়েছে, মাঝখানে সাদা এবং উপরেরটি লাল দিয়ে আঁকা হয়েছে। সাঁওতাল উপজাতির হস্তশিল্পেরও একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ঝুড়ি বুনন, মৃৎশিল্প এবং কাঠের খোদাই।

সাঁওতাল উপজাতির একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে যা তাদের সঙ্গীত, নৃত্য এবং উৎসবে স্পষ্ট। সাঁওতাল সঙ্গীত ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র যেমন বানাম, তমক এবং মান্দার ব্যবহার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সাঁওতাল নৃত্যটি তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও প্রতিফলন, এবং এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেমন বিবাহ, ফসল কাটার উৎসব এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়।

সাঁওতাল উপজাতি সারা বছর অনেক উৎসব পালন করে এবং তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল বাহা উৎসব। বাহা উৎসব ফেব্রুয়ারি মাসে পালিত হয় এবং এটি সাঁওতাল নববর্ষ উদযাপন। উৎসবটি উপহার বিনিময়, ভোজ এবং নাচের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়।

তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সত্ত্বেও, সাঁওতাল উপজাতি বছরের পর বছর ধরে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।নগরায়ন ও উন্নয়নের মুখে এই উপজাতিকে তাদের ঐতিহ্যগত জীবনধারা বজায় রাখতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে এছাড়াও সাঁওতাল উপজাতিকে বৈষম্য ও প্রান্তিকতার সম্মুখীন হচ্ছে যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের দিকে তাদের পরিচালিত করেছে।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, সাঁওতাল উপজাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি নতুন করে মানুষের আগ্রহ দেখা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার সাঁওতাল সংস্কৃতির প্রচার এবং উপজাতিকে সহায়তা প্রদানের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। উপজাতির ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির প্রচারের জন্য সরকার রাজ্যে একটি সাঁওতাল একাডেমিও প্রতিষ্ঠা করেছে।

পরিশেষে, সাঁওতাল উপজাতি পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের অনন্য রীতিনীতি, ঐতিহ্য এবং বিশ্বাস তাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের একটি প্রমাণ। সাঁওতাল সংস্কৃতি সংরক্ষণ এবং প্রচার করা গুরুত্বপূর্ণ যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই উপজাতির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস উপলব্ধি করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সাঁওতাল উপজাতির অবদানকে উপেক্ষা করা যায় না, এবং তাদের ঐতিহ্যকে সুরক্ষিত করা আমাদের দায়িত্ব।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে

বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন

Roop Kishor Soni: একটি আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য তুলে ধরেছেন

উত্তরাপথঃ রাজস্থান মানেই ওজনদার রূপার গহনা ,আর তার উপর কারুকাজ। প্রচলিত এই ধারনা ভেঙ্গে আজ রূপোর গহনাকে আধুনিকতার সাথে শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন রূপ কিশোরী সোনী(Roop Kishor Soni)।তিনি ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তার অসাধারণ শিল্প কর্মের জন্য জাতীয় পুরুস্কার পান। রাজস্থানের জয়সলমেরের শহরের এই শিল্পী ৩.৮ গ্রাম ওজনের ০.৯ সেমি চওড়া রৌপ্য আংটিতে বিশ্বের আটটি আশ্চর্য খোদাই করেছেন।এই ছোট রূপার আংটিতে শিল্পী তাজমহল, সিডনি অপেরা হাউস, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, চীনের গ্রেট ওয়াল, আইফেল টাওয়ার, বিগ বেন, পিসার হেলানো টাওয়ার এবং মিশরীয় পিরামিডের চিত্র এক সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।এছাড়াও তিনি আরও দুটি পৃথক ডিজাইনের অত্যাশ্চর্য আংটি  তৈরি করেছেন।৮.৬ গ্রাম ওজনের একটি রিংয়ে তিনি সূর্যাস্তের সময় ভারতীয় উট সাফারি সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভারতীয় বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন,এবং অন্যটিতে বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবী ছবি এবং মন্দির খোদাই করেছিলেন। শিল্পী বলেছেন যে তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার শৈল্পিক দক্ষতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেই সাথে তিনি বলেন "আমার বাবাও একজন জাতীয় পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি আমাকে শিল্পের এই দক্ষতা শিখিয়েছিলেন কারণ তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিল্পের ফর্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।" .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top