সিপাহী বিদ্রোহের এক শতাব্দী আগে রঘুনাথ মাহাতোর নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহ

বলরাম মাহাতোঃ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা পর্ব বলতে আমরা সাধারণত বুঝি ১৮৫৭ সালের ”সিপাহী বিদ্রোহ” থেকেই। কিন্তু বাস্তবে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখতে পাব এর পূর্বে প্রায় এক শতাব্দী আগে বিপ্লবের আগুন বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যে জ্বলতে শুরু করেছিল। ঝাড়খন্ড রাজ্যে ইংরেজরা যখন ওখানকার জল-জঙ্গলের সাথে সাথে প্রাকৃতিক সম্পদ ও সংস্কৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে তখন ওখানকার আদিবাসীদের মধ্যে দেশপ্রেমের অনুভূতি গড়ে ওঠে এবং এর ফলস্বরূপ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার প্রথম আন্দোলন ঝাড়খন্ড রাজ্যেই সংঘটিত হয় যা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত । শ্রমিক সেনের লেখা এক নজরে পুরুলিয়া এবং ডক্টর ভি ভারত তলোয়ারের লিখা আদিবাসী এবং আরএসএস এবং অযোধ্যা সিং লেখা ভারতের মুক্তি সংগ্রাম বই -এ এই আন্দোলনের বর্ণনা পাওয়া যায়। চুয়াড় বিদ্রোহ পুরো ঝাড়খন্ড রাজ্য সহ ভারতকে প্রভাবিত করে। রাজ্যের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন। যার প্রধান নেতা ছিলেন রঘুনাথ মাহাতো। তার প্রধান স্লোগান ছিল –

”আপনা গাঁও, আপনা রাজ; দূর ভাগাও বিদেশী রাজ”

রঘুনাথ মাহাতো ছিলেন পরাধীনতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার প্রথম নায়ক। রঘুনাথ মাহাতো ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। ১৭৩৮ সালে ২১ শে মার্চ একটি মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সারাইকেল্লা জেলার নিমডি থানার ঘুটিয়াডিহ গ্রামে। রঘুনাথ মাহাতোর বাবার নাম কাশীনাথ মাহাতো আর মা নাম করমী মাহাতো। ছোটবেলা থেকে রঘুনাথ মাহাতো প্রচুর সাহসী ছিলেন,সেইসাথে তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা নির্ভীক ও প্রতিবাদী। ইংরেজ আশ্রিত তহশিল দারেরা যখন এলাকায় আদিবাসীদের দীর্ঘদিন ধরে ভোগ করে আশা জমির উপর করের বোঝা চাপাতে শুরু করলো, তখন রঘুনাথ মাহাতো তার সহযোগীদের সহায়তায় বিরোধিতা করেন। রঘুনাথ মাহাতো মানুষকে সংগঠিত করে এলাকা থেকে ইংরেজ বাহিনীর প্রতি সরাসরি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। তদানীন্তন ইংরেজরা আদিম ও আন্তর্জাতিক কৃষক বিদ্রোহকে ঘৃণা ভরে চুয়াড় বিদ্রোহ নাম দেন। রঘুনাথ মাহাতো তার মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য জমির রাজস্ব দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত হেনেছেন, যা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ রোপণ করেছিল। ধীরে ধীরে রঘুনাথ মাহাতো,পলক মাঝি ,ডমন ভুমিজ, শংকর মাঝিদের সহযোগিতায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে আরও সংঘটিত করেন। ভূমিজ জনগোষ্ঠী ও ঝগড়ু মাহাতোদের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন সশস্ত্র বাহিনী।

তীর -ধনুক -বর্সা সহিত পাঁচ শতাধিক বিপ্লবীদের আক্রমণে ধুলায় মিশে গেল ইংরেজদের সাধের নিমুধল কেল্লা। এইভাবে একের পর এক ব্রিটিশ ঘাঁটি দখল করেন রঘুনাথ মাহাতোর বিপ্লবী বাহিনীরা। ১৭৭৪ সালে বিদ্রোহীরা কিংচুগ পরগনার পুলিশ হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে অত্যাচারী ইংরেজদের হত্যা করেন। পরিস্থিতি এতটাই নাগালের বাইরে চলে গেছিল যে রঘুনাথ মাহাতো কে ধরে আনার জন্য মোটা অঙ্কের পুরস্কারের পর্যন্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয় এই ব্রিটিশ সরকার।
এবং শেষ পর্যন্ত ১৭৭৮ সালের ৫ই এপ্রিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রঘুনাথ মাহাতো শহীদ হন।

খবরটি শেয়ার করুণ

2 thoughts on “সিপাহী বিদ্রোহের এক শতাব্দী আগে রঘুনাথ মাহাতোর নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহ”

  1. এই লেখাটা খুব সুন্দর হয়েছে তবে রঘুনাথ মাহাতোর সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারলে ভালো লাগবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


World’s most polluted cities: নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়

উত্তরাপথঃ দিওয়ালি উদযাপনের একদিন পর জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় উঠে এসেছে।সোমবার, অর্থাৎ দীপাবলির পরের দিন এই শহরগুলির বায়ুর গুণমান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খারাপ হয়েছে।বায়ুর গুনমান খারাপ হওয়ার পেছনে মাত্রাতিরিক্ত আতশবাজি জ্বালানোকে দায়ী করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় যথারীতি প্রথম স্থান দখল করেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। দীপাবলির পরের দিন এটির AQI (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) পরিসংখ্যান ছিল ৪০৭। নভেম্বরের শুরু থেকে, দিল্লিতে AQI পরিসংখ্যান খারাপ হয়েছে।  সুইস গ্রুপ আইকিউএয়ার শহরের বাতাসকে "বিপজ্জনক" বিভাগে রেখেছে।ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়(World’s most polluted cities), ১৫৭ এর AQI সহ ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। কলকাতা ১৫৪ এর AQI সহ সপ্তম স্থানে রয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Fried rice syndrome: আগের দিনের রান্না করা ভাত খেলে হতে পারে এই বিশেষ অসুখটি

উত্তরাপথঃ আপনার কি বাসী ভাত বা পান্তা খাওয়ার অভ্যেস আছে? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম (Fried rice syndrome) নিয়ে আমরা প্রায়ই অবশিষ্ট খাবার গরম করে আবার খাই। কিন্তু জানেন কি এই অভ্যাস আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পর আগের রান্না করা  ভাত খাওয়ার ফলে পেট সংক্রান্ত সমস্যা হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে খাবার পুনরায় গরম করলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, কিন্তু তা নয়। যে খাবারেই স্টার্চ থাকে না কেন, এতে উপস্থিত টক্সিন তাপ প্রতিরোধী। অর্থাৎ খাবার গরম করার পরও ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয় না। ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম নামে এই সমস্যা সম্পর্কিত একটি অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা এই ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম অবস্থার লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ভাত রান্না করার পর, যখন অবশিষ্ট ভাত কয়েক ঘন্টা বা সারারাত ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয় এবং তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে শুরু করে, তখন এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রাইড রাইস সিনড্রোম। .....বিস্তারিত পড়ুন

Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে

বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন

World Children's Day: সত্যিই কি ‘বিশ্ব শিশু দিবস´পালনের কোনও যৌক্তিকতা আছে ?

প্রীতি গুপ্তাঃ হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটি দিন তারপর ১৪ নভেম্বর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে  পালন করা হবে ‘বিশ্ব শিশু দিবস´(World Children's Day)।এই দিনটি শিশুদের মঙ্গলের জন্য, তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুকূল বিশ্ব তৈরি করার প্রচেষ্টার একটি দিন।কিন্তু প্রশ্ন,সত্যি কি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা বিশ্ব জুড়ে শিশু দিবস পালন করার কোনও যৌক্তিকতা আছে? আদৌ কি এর কোনও লাভ আমরা আমাদের প্রান্তিক স্তরের শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি ? সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে রাজস্থানের উদয়পুর শহরে আসা। আমরা সবাই জানি উদয়পুর বিখ্যাত তার হ্রদের কারণে । এখানকার স্থানীয় থেকে পর্যটক সকলেই এই সুন্দর হ্রদগুলির আকর্ষণে বারবার ছুঁটে যায়। ‘ফতে সাহেব লেক’ রাজস্থানের উদয়পুরের এক বিখ্যাত পর্যটক স্থল।এখানে বহু মানুষ সকাল- বিকেল এই লেকের চার ধারে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে পড়ে। সেভাবেই দুই দিন আগে বিকেলে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম ‘ফতে সাহেব লেকের ধারে হাঁটার উদ্দেশ্য নিয়ে। হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বাচ্চাছেলে আওয়াজ করে ডাকছে ,বললাম কিছু বলবি? সে বলল একটু দাঁড়াতে। ও ছুটে গিয়ে হাতে করে কয়েকটি বেলুন নিয়ে এসে হাজির । সে বারবার বেলুন কেনার অনুরোধ জানাতে লাগল। হাতে অন্য কাজের চাপ নেই অনেকটা অবসর সময় তাই আমি অনেকটা সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বললাম ঠিক আছে আমি তোর বেলুন নেব ,কিন্তু তার আগে আমি  তোকে যা বলব তার তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। সে খুশী খুশী রাজি হয়ে গেল । .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top