মানভূমে কৃষিবছরের সূচনা : আখ্যান যাত্রা ( ১ লা মাঘ )

ছবিঃ সংগৃহীত

ড. নিমাইকৃষ্ণ মাহাতঃ ‘আখ্যান‘ কথাটির অর্থ হল  সূচনা পুরুলিয়া জেলা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের মূলনিবাসী ও আদিবাসী কৃষকদের কৃষিবৎসরের সূচনা হয় আখ্যানযাত্রা অর্থাৎ  ১লা মাঘ।  ‘যাত্রা’ কথাটির অর্থ হলো শুভ বা পবিত্র। কৃষকেরা আখ্যান্ দিন অর্থাৎ ১ লা মাঘ দিনটিকে খুবই শুভ ও পবিত্র বলে মনে করে । তাই এই দিনটিকে ‘ আখ্যানযাত্রা ‘ নামে অভিহিত করা হয় । এই পবিত্র দিনে কৃষকেরা নানাবিধ শুভ কর্মের সূচনা করে । এই দিন অনেকে গৃহ নির্মাণের সূচনা করে ,  নতুন গৃহের প্রথম ‘গুড়িচটানো ‘ ( ভিত কাটা) আরম্ভকরে। কৃষকেরা বিশ্বাস করে যে আখ্যান দিনে  সূচনা হওয়া গৃহে বসবাস করলে সংসারের সমৃদ্ধি ঘটবে এবং কোনদিন অভাব হবে না। আখ্যান যাত্রার দিনে আচরণীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষিকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানটি হলো ‘হাল পুণহা’ করা। ঐদিন সকাল থেকে ঘরের মহিলারা ঘর -দোর, উঠান পরিষ্কার করে এবং গোবর জল লেপন করে । ঘর এবং উঠানে আঁকা হয় মাঙ্গলিক চিহ্নস্বরূপ আলপনা এবং মা লক্ষ্মীর পদচিহ্ন । এইভাবে কৃষক পরিবারে সেদিন একটি বিশুদ্ধ পরিবেশ গড়ে তোলা হয়। এই বিশুদ্ধ পরিবেশে নতুন ফাল , হাল, পাশি, জোৎ, বিয়নি ইত্যাদি উপকরণ সহযোগে নতুন কৃষি বৎসরের প্রথম দিনে প্রথম হাল হালকর্ষণ-এর সূচনা করে কৃষক পরিবারের বড় ছেলে। ঐদিন চাষি পূর্ব দিকে মুখ করে নিজের খেতে নিজে আড়াই পা লাঙল  চালায় । এই সামগ্রিক প্রক্রিয়াটিকে হালপুণহা করা বলে।

আড়াই পা লাঙল চালানোর পর কাড়া বা বলদগুলিকে পুকুর বা নদীর জলে ভালো করে ধুয়ে  বাড়ি নিয়ে আসা হয় । কৃষক-গৃহিণী ধান- দূর্বা- সিঁদুর দিয়ে গরু বা কাড়া দুটিকে বরণ করে নেয়। শিং-এ মাখিয়ে দেওয়া হয় তেল এবং তার উপর দেওয়া হয় সিঁদুরের ফোটা। কৃষিকাজে সহায়তা করার জন্য কৃষক গরু- কাড়ার প্রতি এইভাবে তার অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানায়। এরপর হাল পুণহাকারী  গোবর কুঁড়ে কোদাল দিয়ে আড়াই বার কোপ মারে । হাল পুনহাকারী সারাদিন উপবাসে থাকার পর সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানের শেষে দই-চিড়া-গুড় খায়।  ‘ হাল পুণহা ‘- র শেষে দই -চিড়া খাওয়ার ব্যাপারে কৃষকেরা বিশ্বাস করে যে এর ফলে কৃষক পরিবারে সারা বছর  অন্নের  অভাব  হবে না। কৃষিসংস্কৃতি হল সমন্বয়ের সংস্কৃতি। পারস্পরিক আদান- প্রদান , সহযোগিতা ও ভাব বিনিময়ের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে এই যৌথসংস্কৃতি। মানভূমে ‘ আখ্যান  দিন ‘- এ কামার, কুমোর, নাপিত, বাগাল, মাহিন্দার প্রভৃতি বৃত্তিধারী লোকেরা নিজ নিজ গলা ঘর (মনিব ঘর ) ঠিক করে কৃষক পরিবারের সাথে নতুন বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়।

এই পবিত্র দিনে কামার নতুন ফাল, পাসি ইত্যাদি যোগান দিয়ে কৃষক পরিবারের সাথে সারা বছরের জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয়। চাষির সারাবছরের আচার-অনুষ্ঠান, পালপার্বণে মাটির প্রদীপ, হাতি, ঘোড়া, সরা ইত্যাদি সরবরাহ  করার জন্য কুমোর এই দিনেই চাষির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। নাপিত হালপুণহাকারীর নখ, চুল, দাঁড়ি কেটে নিজের ‘গাঁ-ঘর‘ ঠিক করে নেয়। চাষির পরিবারের বাগাল গোচারণের জন্য এবং মাহিন্দার চাষবাস দেখাশোনার জন্য আগামী পৌষসংক্রান্তি পর্যন্তচুক্তিবদ্ধ হয়। মানভূমের বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক ক্ষীরোদচন্দ্র মাহাতো ‘ মানভূমের কৃষিসংস্কৃতি ও পালা পার্বণ  প্রবন্ধে বলেছেন – 

“এ দিনেই ( আখ্যান দিনে ) চাষির খামারে চাপানো হয়  ‘মুনই‘ (মনের আকাঙ্ক্ষা)। উদ্দেশ্য – ‘খামার বুড়হি ‘ -র  পূজা ও আশীর্বাদ কামনা । খামার উপচানো ফসলের দেখভাল করে ‘ খামার বুড়হি ‘। কুমোরের দেওয়া নতুন সরাই  চাপানো হয় ‘ মুনই ‘ । তিন দিকে তিনটি শাল কাঠ পুঁতে আগুনের উত্তাপে সিদ্ধ হয়ে আতপ চাল, দুধ উপচে পড়বে । বিশ্বাস , সরার মুনই উপচে পড়লে খামারের ফসল উপচে পড়বে  । খামার বুড়হি – র আশীর্বাদ -এ ধন্য হবে কৃষককুল । ” ( ‘ যুগের ডাক ‘ (পত্রিকা ) : শারদীয়া , ১৪১৫, সম্পাদক – সজল বসু  । গণ প্রকাশনী এসোসিয়েশন কলকাতা – ৬,  পৃষ্ঠা- ৬৮) ।

চাষিরা এই পবিত্র দিনে বিভিন্ন লোকদেবতা ও গ্রাম দেবতার পূজা করে। আসন্ন কৃষি মরসুমে যাতে চাষবাস ভালো হয় এবং পরিবারের তথা গ্রামের মঙ্গল কামনায় তারা বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবী ও গ্রাম দেবতার পূজা করে।

আখ্যান দিন অর্থাৎ  ১ লা মাঘ থেকেই গ্রামে গ্রামে ভানসিং এর পূজা শুরু হয়। ভানসিং  অর্থাৎ ভানুসিংহ বা সূর্য ঠাকুরের পূজা । নির্ধারিত দিনে দিনে বিভিন্ন গ্রামে ভানসিংট্যাঁড়ে (মাঠে )’ ভানসিং মেলা ‘ বসে। এই সময় কোন একজন ভক্তের উপর দেবতা ‘ভর‘ করেন । তখন সেই ভক্ত তীব্র আবেগ ও উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। ওই ভক্ত ঝুপতে (ছটফটানি সহ কাঁপা) থাকে বলে তাকে ‘ ঝুপ্যার ‘ বলে। এই ঝুপ্যার-কে প্রশ্ন করে চাষিরা নিজেদের ভাগ্য এবং আসন্ন কৃষি মরসুমে চাষবাস কেমন হবে- তা জেনে নেয়। গ্রামের চাষাভূসা মানুষ বিশ্বাস করে যে ঝুপ্যার- এর মাধ্যমে দেবতাই তাদের ভাগ্যফল ও ‘কৃষিবর্ষ ফল‘ বলে দেন ।

গ্রাম দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য কৃষকেরা ছাগল পাঁঠা , শুকর, মোরগ, পায়রা ইত্যাদি বলি দেয়।  তারা বিশ্বাস করে যে, দেবতা সন্তুষ্ট হলে ফসল উৎপাদন ভালো হবে এবং গ্রামে মহামারি , খরা , দুর্ভিক্ষ , বন্যা ইত্যাদি হবে না।

কোথাও কোথাও গ্রাম দেবতার থান -এ আখ্যানদিনে  মাটির হাতি , ঘোড়া ইত্যাদি দেওয়া হয় । গ্রামের থানে সেদিন লায়া পূজা করেন। চাষিরা ভক্তি ভরে থানগুলিতে দলে দলে সমবেত হয় । গ্রামীণ জীবনের সহজ- সরল চাষিরা বিশ্বাস করে যে, গ্রামদেবতার উদ্দেশ্যে হাতি, ঘোড়া অর্পণ করা হলে তিনি ওই হাতি, ঘোড়ায় চেপে গ্রাম প্রদক্ষিণ করবেন এবং গ্রামকে সমস্ত কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করবেন । এই আখ্যানদিনে অর্থাৎ  ১ লা মাঘ পুরুলিয়া জেলা ও সংলগ্ন অঞ্চলের চাষাভুসো মানুষগুলো অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে।

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Karar Oi Lauh Kapat: কাজী নজরুলের এই গানকে ঘিরে  বিতর্কে এ আর রহমান

উত্তরাপথঃ বিতর্কে 'পিপ্পা' ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান।সম্প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার একটি হিন্দি ছবিতে কবির জনপ্রিয় গান 'করার ঐ লৌহ কাপাত...' (Karar Oi Lauh Kapat )।কিন্তু এ আর রহমানের সঙ্গীত পরিচালনায় ওই গানটি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে আপত্তি জানিয়েছে নজরুল পরিবার।বিতর্কের পর যে চুক্তির আওতায় ওই গানটি ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে আনার দাবি তুলেছে কবির পরিবার।'পিপ্পা' শিরোনামের হিন্দি চলচ্চিত্রটি যেখানে (Karar Oi Lauh Kapat )গানটি ব্যবহার করা হয়েছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন ভারতীয় সেনা সৈনিককে কেন্দ্র করে একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ছবির সঙ্গীত পরিচালক অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান। গানের কথা ঠিক রেখেও সুর পাল্টানোর অভিযোগে ভারত ও বাংলাদেশে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।কবির পরিবারের অভিযোগ, গানটি ব্যবহারের অনুমতি দিলেও সুর পরিবর্তনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।পরিবারের সদস্যরাও ছবিটি থেকে গানটি বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

PAN-Aadhar link: কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে নিষ্ক্রিয় করেছে

উত্তরাপথ : আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link)করার সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ড নিষ্ক্রিয় করেছে৷ আপনি যদি এখনও প্যান কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিঙ্ক না করে থাকেন, তাহলে আপনি সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের আওতায় এসেছেন। আপনি যদি আপনার আধার কার্ডকে প্যানের সাথে লিঙ্ক করতে চান তবে আপনি জরিমানা দিয়ে এটি সক্রিয় করতে পারেন। কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে আধারের সাথে লিঙ্ক না করার কারণে নিষ্ক্রিয় করেছে। একটি আরটিআই-এর জবাবে, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়েছে যে আধার কার্ডের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link) করার সময়সীমা ৩০ জুন শেষ হয়েছে। যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড লিঙ্ক করেননি তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশে ৭০ কোটি প্যান কার্ড বর্তমানে ভারতে প্যান কার্ডের সংখ্যা ৭০.২ কোটিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৭.২৫ কোটি মানুষ আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক করেছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক

উত্তরাপথঃ সারা বিশ্বের জনসংখ্যার বয়স বৃদ্ধির সাথে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের প্রকোপ বাড়ছে৷ তাদের এই  সমস্যাগুলি যে কেবল তাদের একার সমস্যা তা নয় ,এটি ধীরে ধীরে পুরো পারিবারিক সমস্যার আকার নেয়।সম্প্রতি বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য গবেষকদের মধ্যে কার্যকর কৌশল খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।বর্তমানে বেশীরভাগ গবেষক মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে প্রোবায়োটিক কি? কেনই বা গবেষকরা মস্তিস্কের স্বাস্থ্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন । .....বিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বকাপ ২০২৩: পাকিস্তানকে হারিয়ে Afghanistan এ ঈদের মতো পরিস্থিতি

আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ২২ তম ম্যাচে আফগানিস্তান পাকিস্তানকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে। সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানিস্তান। এই প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে হারাল আফগানিস্তান আর এই পাকিস্তানকে হারিয়ে আফগানিস্থানে(Afghanistan)এখন ঈদের মতো পরিস্থিতি।এক আফগানিস্থানি সমর্থকের মতে এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এবং নিজেদের মত করে তারা তাদের এই খুশী উদযাপন করেছেন। এক্স হ্যান্ডেলে এক সমর্থকের মতে, সেদিন উদযাপন ছিল, পার্টি ছিল। এটি ছিল আমাদের ইতিহাসের একটি বিরল মুহূর্ত যখন পুরো জাতি খুশি ছিল এছাড়াও, এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের তৃতীয় বড় আপসেট । টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাবর আজমের দল। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান দল ২৮২ রান করে। জবাবে আফগানিস্তান দল ২৮৩ রান তাড়া করে ৪৯ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য অর্জন করে। এই ম্যাচে হারের পর বেশ ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল অধিনায়ক বাবর আজমকে। ম্যাচ-পরবর্তী উপস্থাপনার সময়, তিনি দলের ত্রুটিগুলি তালিকাভুক্ত করেছিলেন এবং পরাজয়ের জন্য নিজেদের দায়ী করেছিলেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top