দ্বিতীয় পর্ব
ড. সায়ন বসু*
উত্তরাখণ্ড-এর নৈনিতালে অবস্থিত আর্যভট্ট পর্যবেক্ষণমূলক বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র (ARIES)| ছবিটি ARIES- এর ওয়েবপেজ থেকে সংগৃহীত।
সিদ্ধান্তিক যুগের পরে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানে “যিজ যুগ”-এর শুরু হলেও পূর্ববর্তী যুগের প্রভাব থেকেই গেলো। যিজ হলো ইসলামিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি বই যেখানে সূর্য, চাঁদ এবং গ্রহদের অবস্থান গণনার পদ্ধতি সম্বন্ধে তথ্য দেওয়া আছে । “যিজ” শব্দটি এসেছে মধ্য-পারস্যের শব্দ “যিগ” (Zig) থেকে । বুননের সময় সুতো দিয়ে যে সারি (row) এবং স্তম্ভ (column) করা হয় তাকেই বলা হয় “যিগ” । সেখান থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি বই যেখানে সূর্য, চাঁদ এবং গ্রহদের অবস্থান সারি (row) এবং স্তম্ভ (column)-এর আকারে বোঝানো হয়েছে তার নাম হয়ে যায় “যিজ”। যিজ-ই-সুলতানি প্রকাশিত হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং তিমুরের সুলতান উলুঘ বেগ-এর হাত ধরে । মোগল সম্রাট হুমায়ুনও দিল্লীর কাছে একটি মানমন্দির তৈরি করেন ।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর আম্বেরের রাজা দ্বিতীয় জয় সিংহের হাত ধরে জ্যোতির্বিজ্ঞান আবার ফিরে এলো ভারতে| অষ্টদশ শতাব্দীতে রাজা জয় সিংহ বেশ কয়েকটি বড় বড় মানমন্দির তৈরি করেন যেগুলিকে যন্ত্র-মন্দির (বা যন্তর-মন্তর) বলা হয় । দিল্লী, জয়পুর, উজ্জয়ন, বেনারস, এবং মথুরাতে যন্তর-মন্তর দেখতে পাওয়া যায় । জয়পুরেই ১৯ টি বিভিন্ন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গণক (astronomical calculator) আছে । জয় সিংহের তৈরি করা গণকগুলির মধ্যে বিখ্যাত হল “সম্রাট যন্ত্র” যেটি বিশ্বের সব থেকে বড় সূর্যঘড়ি । বলে রাখা ভালো যে, জয়পুরের যন্তর-মন্তরের গণকগুলি এখন সচল ।
অনেকেই জানলে অবাক হবেন যে ষোড়শ শতকে বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় যাজক ভারতে টেলিস্কোপ নিয়ে এসেছিলেন সাথে এও বলে রাখা ভালো যে ১৬১৯ সালে গোয়ার একটি চার্চ থেকে এক ধূমকেতুও দেখা হয় টেলিস্কোপের সাহায্যে । ১৬১৯ অর্থাৎ গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ ব্যবহারের ১০ বছর পরে| ঔপনিবেশিক ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা পুরোদমে শুরু মোটামুটিভাবে ১৭৫০ সাল থেকে । ১৭৮৬ সালে মাদ্রাস মানমন্দির তৈরির পর থেকে বলা যায় জ্যোতির্বিজ্ঞান আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঢুকে পড়লো । মাদ্রাস মানমন্দিরকে ব্যবহার করা হতে থাকলো উপকূলবর্তী অঞ্চলের ভৌগোলিক জরিপ ইত্যাদির কাজে । ইউরোপের বাইরে প্রথম জনগণের জন্য মানমন্দিরটিও তৈরি হয় ভারতেই উইলিয়াম পেতিয়ার (১৮১৬)-এর হাত ধরে । বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী নরমান রবার্ট পগসন মাদ্রাস মানমন্দিরের অধিকর্তার পদও সামলেছেন ১৮৬১ এবং ১৮৮৫ এর মধ্যে । এই সময়কালের মধ্যে তিনি পাঁচটি ছোট ছোট গ্রহ আবিষ্কারও করেন যাদের মধ্যে প্রথমটির নাম দেন “এশিয়া”।
ইংরেজ শাসনে থাকাকালীনও ভারতবর্ষে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় ভাটা পড়েনি বরং তা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আরও বিকশিত হয়েছে । প্রথিতযশা বিজ্ঞানী যেমন মেঘনাদ সাহা, হোমী ভাবা তার সাথে ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ সায়েন্স (IISc)-এর মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে বিজ্ঞান চর্চা সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চাও এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে । পরবর্তীকালে ১৯৪৫ সালে হোমী ভাবা তৎকালীন বোম্বেতে প্রতিষ্ঠা করলেন টাটা ইন্সিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (TIFR) প্রতিষ্ঠান যা কিনা অসংখ্য প্রথিতযশা বিজ্ঞানী আজও উপহার দিয়ে যাচ্ছে দেশকে ।
হোমী ভাবা যাকে একপ্রকার ভারতবর্ষে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং পারমানবিক পদার্থবিদ্যায় (Nuclear Physics) গবেষণায় পথপ্রদর্শকই বলা যেতে পারে, তিনি মূলত মহাজাগতিক রশ্মি এবং “বেলুন এক্সপেরিমেন্ট”-এ আগ্রহী ছিলেন যেগুলি IISc এবং TIFR-এ করা হয়েছিল । পরবর্তীকালে ভাবাই বিক্রম সারাভাইকে উৎসাহিত করেন মহাকাশ গবেষণা শুরু এবং তা এগিয়ে নিয়ে যেতে যেখান থেকে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ISRO)-এর পথ চলা শুরু । পরবর্তীকালে অধ্যাপক গোবিন্দ স্বরূপ (১৯২০ – ২০২০) এবং অন্যান্য অধ্যাপকগণ যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এবং রিসার্চ ইন্সিটিউটগুলিকে চিঠি লেখেন রেডিও অ্যাস্ট্রোফিজিক্স-এ গবেষণা শুরু করতে তখনও হোমী ভাবাই সেই উদ্যোগকে সমর্থন করেন । অধ্যাপক স্বরূপ এবং অন্যান্য গবেষকরা মিলে তৈরি করেন দুটি বিশ্ববিখ্যাত রেডিও টেলিস্কোপ – উটি রেডিও টেলিস্কোপ (১৯৭০) এবং Gaint Metrewave Radio Telescope (GMRT) (১৯৯৮)। সেই সময়ে ব্যাঙ্গালোর ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার ভরকেন্দ্র তা মূলত শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য| ৭০-এর দশকে অধ্যাপক ভাইনু বাপ্পু যিনি ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (IIA)-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিষদ (International Astronomical Union বা IAU)-এর সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন । IIA ভারতের মাটিতে বেশকিছু অপ্টিকাল টেলিস্কোপ (যে টেলিস্কোপে আয়না লাগানো থাকে) বসিয়েছে তাদের মধ্যে তামিলনাড়ুর কাভালুরে অবস্থিত ভাইনু বাপ্পু মানমন্দির এবং লাদাখ-এর হ্যানলেতে অবস্থিত হিমালায়ান চন্দ্র টেলিস্কোপ উল্লেখযোগ্য । ভারতবর্ষে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণাতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলির অবদানও অস্বীকার করা যায় না । যেমন “উত্তরপ্রদেশ রাজ্য মানমন্দির” অনেক বছর ধরে উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকার দ্বারা পরিচালিত ছিল । এই মানমন্দিরটিকে এখন আমরা আর্যভট্ট পর্যবেক্ষণমূলক বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র (ARIES) যা উত্তরাখণ্ড-এর নৈনিতালে অবস্থিত এবং এখানে দেশের সবথেকে বড় অপ্টিকাল টেলিস্কোপটিও আছে যার নাম দেবস্থল অপ্টিকাল টেলিস্কোপ (DOP)।
১৯৮৮ সালে University Grants Commission থেকে একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয় যার নাম আন্তঃ-বিশ্ববিদ্যালয় জ্যোতির্বিজ্ঞান কেন্দ্র (Inter University Center for Astronomy and Astrophysics বা IUCAA) যার প্রথম অধিকর্তা ছিলেন অধ্যাপক জয়ন্ত নারলিকার ।
(বাম থেকে ডান)- আলবার্ট আইন্সটাইন, হেডেকী য়ুকাও, জন হুইলারের সাথে হোমী ভাবা | ছবিটি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবপেজ থেকে সংগৃহীত ।
বর্তমানে ভারতবর্ষ জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় পৃথিবীতে যে নিজের জায়গা করে নিয়েছে তা বলাই যায় । বিশ্বের সব থেকে বড় রেডিও টেলিস্কোপ যা কিনা দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়াতে বসানো হচ্ছে তাতেও ভারতবর্ষের বেশ কিছু প্রথিতযশা গবেষণাকেন্দ্র অংশীদার হিসেবে কাজ করছে । সব মিলিয়ে বলাই যায় যে আর্যভট্ট, বরাহমিহির -এর হাত ধরে যিজ-যুগ পেরিয়ে বর্তমানে জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা এবং গবেষণা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তাতে করে ভারতবর্ষ ভবিষ্যতে পৃথিবীকে নতুন নতুন আবিষ্কার এবং মৌলিক গবেষণা উপহার দেবে এমন আশা করাই যায় ।
* লেখক বর্তমানে the University of Witwatersrand-এর Centre for Astrophysics-এ কর্মরত রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির গবেষক ।
যোগাযোগ- sayan.basu@wits.ac.za
আরও পড়ুন
আগামী ৩ বছরে শূন্য বর্জ্য হওয়ার পথে রাজস্থানের প্রথম গ্রাম
উত্তরাপথঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের একটি প্রকল্পের আওতায় আঁধি গ্রামে এই পরিবর্তন করা হচ্ছে।জয়পুর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আন্ধি গ্রাম।আগামী তিন বছরে এই গ্রাম শূন্য বর্জ্য হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে ।আন্ধি গ্রামের এই সম্পূর্ণ রূপান্তরটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের একটি প্রকল্পের অধীনে করা হচ্ছে। এই প্রকল্পটি সবুজ প্রযুক্তির হস্তক্ষেপ ব্যবহার করে আন্ধি গ্রামকে জিরো ওয়েস্ট মডেলে রূপান্তরিত করার কাজ চলছে । এই প্রকল্পটি ২১ মার্চ ২০২২ এ শুরু হয়েছে, প্রকল্প পরিচালক বলেন, এ গ্রামের অবস্থা আগে খুবই খারাপ ছিল।আগে এই গ্রামের লোকেদের কঠিন বর্জ্য আলাদা করার কোনও ধারনা ছিল না । .....বিস্তারিত পড়ুন
তিব্বতে ওজোন স্তরের গর্ত গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টিপাতকে প্রভাবিত করছে
উত্তরাপথঃ ওজোন স্তর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একটি অপরিহার্য দিক, যা স্ট্রাটোস্ফিয়ারে অবস্থিত। এটি সূর্য দ্বারা নির্গত ক্ষতিকারক অতিবেগুনী (UV) বিকিরণ থেকে আমাদের রক্ষা করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ওজোন স্তরের অবক্ষয় , বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর ধরনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে । এরকম একটি পরিণতি হল তিব্বতে ওজোন স্তরের গর্ত যা সেখানকার গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টিপাতকে প্রভাবিত করছে।তিব্বতকে, প্রায়শই "বিশ্বের ছাদ" হিসাবে উল্লেখ করা হয়।এটি একটি বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র এবং অনন্য আবহাওয়ার নিদর্শন সহ এক বিশাল অঞ্চল। এর বিশাল এলাকা জুড়ে উচ্চ পর্বতমালা, মালভূমি এবং গভীর উপত্যকা রয়েছে । .....বিস্তারিত পড়ুন
বৈধ নথি ছাড়া প্লেনে ওঠার চেষ্টা এটি কি নিছক কৌতুহল মেটানো
উত্তরাপথঃ এটি কি নিছক কৌতুহল না কি কিশোর দুস্ক্রিয়তা। সম্প্রতি বাংলাদেশ এর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাসপোর্ট, টিকিট বা বোর্ডিং পাশ কোনও কিছু ছাড়াই জুনায়েদ নামের ১২ বছরের এক শিশু বৈধ নথি ছাড়া বিনা বাধায় কুয়েত এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে উঠে পড়ে। তবে এবারই প্রথম নয়, এর আগেও প্লেনে চড়তে ব্যর্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গেছে। এবার কৌশল পালটে বিমানবন্দরে ঢোকে শিশুটি। এ ঘটনায় বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটি বিভাগের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি। যে এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে এ ঘটনা ঘটে, সেই কুয়েত এয়ারলাইন্সকেও শোকজ করা হয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেছেন, ছেলেটি ব্রোকেন ফ্যামেলি .....বিস্তারিত পড়ুন
WORLD CUP 2023: আফগানিস্তান ১৫ সদস্যের দল ঘোষণা করল,অধিনায়কত্ব করবেন হশমতুল্লাহ শাহিদি
উত্তরাপথঃ আগামী মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ২০২৩-এর জন্য একটি শক্তিশালী ১৫ সদস্যের দল ঘোষণা করেছে,এই দলে ফিরেছেন নবীন-উল-হক। ৫ অক্টোবর থেকে ভারতে শুরু হতে চলেছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ,চলবে১৯ নভেম্বর পর্যন্ত। এই বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের দলে ফিরেছেন নবীন-উল-হক, যিনি এশিয়া কাপে দলের অংশ ছিলেন না।১৫ সদস্যের আফগান দলের অধিনায়কত্ব করবেন হশমতুল্লাহ শাহিদি ।একই সময়ে, ২৩ বছর বয়সী অলরাউন্ডার আজমতুল্লাহ ওমরজাই, যিনি এশিয়া কাপের দলে ছিলেন না, তিনিও বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেয়েছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন