ছাতাপরব: মানভূম অঞ্চলের রাজাদের এক বিজয় উৎসব

মহানন্দ মাহাতোঃ পশ্চিমবঙ্গের মানভূম অঞ্চলের ‘ছাতাপরব’ হল একটি প্রাণবন্ত ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় অনুষ্ঠান ।ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিনে পুরুলিয়ার চাকলতোড়ে ‘ছাতা মেলা’র মাঠে বিশাল বড়ো এক মেলা বসে। এই  মেলায় শুধুমাত্র পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের মানুষেরা নয়, লাগোয়া ঝাড়খণ্ড বা ওড়িশা থেকে আসা লোকজনও এই দিনটিতে এখানে আসেন এবং ‘ছাতাপরব’উৎসবে সামিল হয়।তবে এই উৎসবের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস এবং পঞ্চকোট রাজবংশের নাম। আজও এই একটি দিনে সিংদেও রাজবংশের এই রাজকুমারকে এলাকার সকলে রাজা বলেই মান্য করেন ।

 প্রাচীন প্রথা মেনে পঞ্চকোট রাজপরিবারের সদস্যদের হাতে এক বিশাল সাদা ছাতা খোলার মধ্যে দিয়ে এই উৎসবের সূচনা হয়।জনশ্রুতি রয়েছে যে, পঞ্চকোটের রাজাদের কুলদেবতা ছিলেন শ্যামরঘুবর, তাঁর ছাতার রং সাদা সেই থেকে ছাতাপরবে যে-ছাতা রাজা উত্তোলন করেন সেই ছাতার রং সাদা হয় । এই ছাতাটিকে বর্তমানে ইন্দ্রদেবের ছাতা বলা হয়। একটা বড়ো শালকাঠকে  পরিষ্কার করে তার মাথায় বাঁশের গোলাকার ছাতা তৈরি করে রীতিমেনে সাদা  কাপড় দিয়ে ছাতাটি মুড়ে দেওয়া হয়।

এক সময় রাজা রাজবেশ পরিধান করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে সপার্ষদ ছাতাটাঁড়ে আসতেন ,পুরোহিত  ইন্দ্রদেবের পুজো করার পর রাজা ঘোড়ার পিটে চেপে ছাতা উত্তোলন করতেন।প্রসঙ্গত যে স্থানটিতে রাজা ছাতা উত্তোলন করেন, সেই স্থানকে ছাতাটাঁড় বলা হয়। বর্তমানে সময় পাল্টেছে রাজ পরিবারের প্রতিনিধি ঘোড়ার বদলে আসে চারচাকা গাড়িতে কিন্ত রাজবেশ পরিধান করে এরপর রীতি মেনে প্রথমে চারচাকা গাড়িতে করে প্রদক্ষিণ করে ছাতাকে। এরপর বেদীতে উঠে রাজা সাদা রুমাল উড়ইয়এ দেন। আর সেই সঙ্কেত দেখেই প্রজারা ছাতা উত্তোলন করেন।   

এই ছাতাপরব বা ছাতা উৎসবের সূচনা ঠিক কবে থেকে সেই ব্যাপারে স্থানীয় মানুষেরাও সঠিক ভাবে কিছু জানেনা, তবে বেশীর ভাগ মানুষের বক্তব্য ,তারা খুব ছোট থেকেই এই উৎসব দেখে আসছেন। প্রতিবছর এখানকার মানুষেরা এই উৎসব দেখতে সপরিবারে আসেন। এই ছাতা উৎসব মানভূম অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের কাছে বরাবরই খুব আকর্ষণীয় এক উৎসব। এতে সামিল হতে কাতারে কাতারে মানুষ ভাদ্র মাসের শেষ দিন চাকলতোড় মাঠে ভিড় জমান।  

মেলায় আসা এক প্রবীন ব্যক্তি এই মেলা সম্পর্কে জানান, কোনও এক সময় পঞ্চকোট রাজবংশের এক রাজা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। কিন্তু, বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পরেও রাজার কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। রাজা যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন, না পরাজিত, সে সম্পর্কে রাজ্যের প্রজা বা পরিবারের সদস্যেরা সকলেই খুব চিন্তায় ছিলেন।সেই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনকার মত উন্নত ছিলনা, দূত ছিল খবরের একমাত্র মাধ্যম। রাজপরিবার সহ রাজ্যের সবাই ধরেই নিয়েছিল রাজা আর নেই। বেশ কিছু দিন পর হঠাৎই একদিন খবর এল, রাজা যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ফিরে আসছেন। রাজার বিজয়ের এই বার্তা প্রজাদের মধ্যে দিতেই নাকি ছাতা উৎসবের শুরু।রাজার এই বিজয়ের কথা যেদিন প্রজাদের জানানো হয় সেই দিনটি ছিল ভাদ্র সংক্রান্তির দিন।সেই থেকে আজও পুরুলিয়াতে বিজয় দিবস হিসাবে ভাদ্র সংক্রান্তির দিনটিতে ছাতা উৎসব পালন করা হয়।

পরবর্তী কালে পঞ্চকোট থেকে এই উৎসব চাকলতোড়ের রাজাদের কাছে চলে যায়। তখন বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষজনকে নিয়ে আনন্দ করার মতো কোনও উৎসব চাকলতোড়ে ছিল না। তবে আজও কাশীপুরে ছাতামাড়া নামে একটি জনপদ রয়েছে। ইতিহাস বলছে, পঞ্চকোটের রাজধানী যখন কাশীপুরে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছিল, তখন থেকেই ভাদ্র সংক্রান্তিতে ছাতা তোলা হত রাজবংশের কোনও সদস্যের হাত দিয়ে ।

আজও উৎসবের রীতি মেনে রাজবাড়ি থেকে মাঠ অবধি পথের দু’ধারে মানুষ দাঁড়িয়ে রাজাকে উদ্দেশ করে ফুল ও দুর্বাঘাস দিয়ে রাজাকে অভিবাদন জানায়।এই একটি দিনের জন্য চাকলতোড়ে আবার রাজতন্ত্র ফিরে আসে ছাতাপরব বা ছাতা উৎসবের হাত ধরে।  

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


PAN-Aadhar link: কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে নিষ্ক্রিয় করেছে

উত্তরাপথ : আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link)করার সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ড নিষ্ক্রিয় করেছে৷ আপনি যদি এখনও প্যান কার্ডের সাথে আধার কার্ড লিঙ্ক না করে থাকেন, তাহলে আপনি সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপের আওতায় এসেছেন। আপনি যদি আপনার আধার কার্ডকে প্যানের সাথে লিঙ্ক করতে চান তবে আপনি জরিমানা দিয়ে এটি সক্রিয় করতে পারেন। কেন্দ্র সরকার ১১.৫ কোটি প্যান কার্ডকে আধারের সাথে লিঙ্ক না করার কারণে নিষ্ক্রিয় করেছে। একটি আরটিআই-এর জবাবে, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়েছে যে আধার কার্ডের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক (PAN-Aadhar link) করার সময়সীমা ৩০ জুন শেষ হয়েছে। যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড লিঙ্ক করেননি তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশে ৭০ কোটি প্যান কার্ড বর্তমানে ভারতে প্যান কার্ডের সংখ্যা ৭০.২ কোটিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৭.২৫ কোটি মানুষ আধারের সাথে প্যান কার্ড লিঙ্ক করেছেন। .....বিস্তারিত পড়ুন

World’s most polluted cities: নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়

উত্তরাপথঃ দিওয়ালি উদযাপনের একদিন পর জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় উঠে এসেছে।সোমবার, অর্থাৎ দীপাবলির পরের দিন এই শহরগুলির বায়ুর গুণমান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খারাপ হয়েছে।বায়ুর গুনমান খারাপ হওয়ার পেছনে মাত্রাতিরিক্ত আতশবাজি জ্বালানোকে দায়ী করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় যথারীতি প্রথম স্থান দখল করেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। দীপাবলির পরের দিন এটির AQI (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) পরিসংখ্যান ছিল ৪০৭। নভেম্বরের শুরু থেকে, দিল্লিতে AQI পরিসংখ্যান খারাপ হয়েছে।  সুইস গ্রুপ আইকিউএয়ার শহরের বাতাসকে "বিপজ্জনক" বিভাগে রেখেছে।ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়(World’s most polluted cities), ১৫৭ এর AQI সহ ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। কলকাতা ১৫৪ এর AQI সহ সপ্তম স্থানে রয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে

উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

দীপাবলির সময় কেন পটকা ফোটানো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায় না ?

উত্তরাপথঃ দীপাবলির পরের দিন, যখন কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (CPCB) শহরের বায়ু মানের সূচকের তালিকা প্রকাশ করে,তখন  দেখা যায় রাজধানী দিল্লি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দূষিত শহরের প্রথমেই রয়েছে। CPCB-এর মতে, ১২ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় দিল্লির বায়ু মানের সূচক ছিল ২১৮ যা ভোরের দিকে বেড়ে ৪০৭ এ পৌঁছায় । ৪০০ – ৫০০ AQI  এর স্তর সুস্থ ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। দীপাবলির সারা রাত, লোকেরা পটকা ফাটিয়ে দীপাবলি উদযাপন করে। ১৩ নভেম্বর বিকেল ৪ টায় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আবার তথ্য প্রকাশ করে এই তালিকায়, দিল্লির গড় বায়ু মানের সূচক ছিল ৩৫৮ যা 'খুব খারাপ' বিভাগে পড়ে।   বায়ু দূষণের এই পরিস্থিতি শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।  নয়ডার বায়ু মানের সূচক ১৮৯ থেকে ৩৬৩ এ এবং রোহতক, হরিয়ানার ১৩৭ থেকে বেড়ে ৩৮৩ হয়েছে। দীপাবলির দুই দিন দিল্লি ,নয়ডা  ,কলকাতা, মুম্বাই সহ দেশের অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। এই দিনগুলিতে মানুষ বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাতীয় রাজধানী দিল্লি এবং নয়ডায় সবুজ পটকা ছাড়া যে কোনও ধরণের আতশবাজি ফাটান সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। আদালত সবুজ পটকা পোড়ানোর সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছে রাত ৮টা থেকে ১০টা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের মানে কী?  আদালতের এই আদেশ কি এখন প্রত্যাহার করা উচিত?  পুলিশ কেন এই আদেশ কার্যকর করতে পারছে না?  এর জন্য কি পুলিশ দায়ী নাকি সরকারের উদাসীনতা রয়েছে এর পেছনে? .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top