জুন মাস থেকে উত্তরাখণ্ডে শুরু হতে চলা নক্ষত্রসভার একটি বিজ্ঞাপন। ছবিটি Indiator Travel এর X-handle থেকে সংগৃহিত।
ড. সায়ন বসুঃ আমরা যারা শহরে বা “শহর ঘেঁষা গ্রামে” বড় হয়েছি, একটু মনে করলে দেখবো যে রাতের আকাশে “দৃশ্যমান” তারার সংখ্যা আস্তে আস্তে কমে গেছে বা যাচ্ছেও। এর পিছনে কোনো মহাজাগতিক ঘটনা নেই বরং আছে আমাদেরই তৈরী করা আলোক দূষণ! রাতের অন্ধকার দূর করতে গিয়ে আমরা রাতের আকাশের অপরূপ সৌন্দর্য্যকেই একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছি| আর এই আলোক দূষণ নামক দৈত্যের থাবা এখনও যে সব জায়গাতে পড়েনি তাদের নিয়েই গড়ে উঠছে ভারতের প্রথম নক্ষত্রসভা। Astro tourism (অ্যাস্ট্রো ট্যুরিজম) এই ইংরেজি শব্দবন্ধটি অ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজম থেকে এসেছে যাকে বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যটন| এটি আসলে সেই সমস্ত জায়গাকে বোঝায় যেখানে গেলে তারা, গ্রহ, ছায়াপথ এবং অন্যান্য জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক বস্তুগুলিকে ভালোভাবে দেখা যায় মূলত কোনো আলোক দূষণ ছাড়া।
পৃথিবী জুড়ে এই মূহুর্তে হাতে গোনা কয়েকটি জায়গা আছে যেগুলিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায় । এগুলির মধ্যে আছে চিলির আটাকামা মরুভূমি, আমেরিকার উটাহ প্রদেশের Natural Bridges National Monument, মিশরের White Desert এবং Nuweiba, জাপানের Iriomote-Ishigaki National Park, জর্ডনের Petra এবং Wadi Rum, দক্ষিণ আফ্রিকার Kruger National Park, এবং ফ্রান্সের Pic du Midi। এবার এই তালিকায় যোগ হলো ভারতের উত্তরাখন্ড পর্যটন দপ্তর এবং Starscapes নামক একটি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠা “নক্ষত্র সভা”। এটি মুসৌরিতে শুরু হলেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরবে উত্তরকাশী, পিথোরাগড়, নৈনিতাল, এবং চামোলি পর্যন্ত।
ভারত, তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যার ঐতিহ্য সহ, জ্যোতির্-পর্যটন উৎসাহীদের জন্য একটি প্রধান গন্তব্য হিসাবে ধীরে ধীরে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে৷ হিমালয়ে অবস্থিত The Indian Astronomical Observatory থেকে শুরু করে রাজস্থানের মরুভূমিতে প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানের জায়গাগুলি, মহাজাগতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়। ভারতে জ্যোতির্-পর্যটকদের জন্য একটি মূল আকর্ষণ হল এর বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক ভূখণ্ড যা তারা দেখা শুরু করে বিভিন্ন সুযোগ প্রদান করে। যেমন প্রায় ৪,৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত লাদাখে ইন্ডিয়ান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরি থেকে রাতের আকাশের শ্বাসরুদ্ধকর অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। দর্শকরা আকাশগঙ্গা (Milky Way) ছায়াপথ সাথে অন্যান্য গ্রহগুলিকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে দূরবর্তী ছায়াপথ এবং নক্ষত্রপুঞ্জের আভাসও দেখতে পারে।
নক্ষত্র সভা জুনের শুরুতে মুসৌরির জর্জ এভারেস্টে শুরু হতে চলেছে এবং এটি ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলবে| এর মধ্যে উত্তরাখণ্ড জুড়ে বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের ইভেন্টেরও আয়োজন করা হবে। এই ইভেন্টগুলি শুধুমাত্র স্টারগেজ বা তারা দেখার সুযোগই দেবে না বরং উত্তরকাশী, পিথোরাগড়, নৈনিতাল এবং চামোলির মতো জেলাগুলিতে রাতের আকাশ পরিষ্কারভাবে দেখার জায়গাগুলির অন্বেষণও করবে৷ এর সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে সেমিনার এবং ওয়েবিনার হবে যা এই উদ্যোগের শিক্ষাগত দিকটিকেও উন্নত করবে।
স্থানীয় বাসিন্দা যারা এই পর্যটন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে উৎসাহী তাদের আলাদা করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। পর্যটন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান এই দুইয়ের মিশেলে নক্ষত্রসভা স্থানীয় অর্থনৈতিক অবস্থায় যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে তা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না । এর সাথে নক্ষত্রসভার মাধ্যমে রাতের আকাশকে আলোকদূষণ থেকে সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টাও করা হবে। বেশ কয়েকজন অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নিয়ে গড়ে ওঠা একটি প্রাইভেট সংস্থা Starscapes,(প্রতিষ্ঠাতা হলেন রামাশীষ রায়), উত্তরাখন্ড পর্যটন বিভাগের সাথে মিলে নক্ষত্রসভার সূচনা করলেও Starscapes এর ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি জায়গায় মানমন্দির আছে যেমন দক্ষিণভারতের মাদিকেরি এবং কূর্গ, উত্তরখন্ডের কৌশানি, ভীমতাল এবং মুক্তেশ্বর। নক্ষত্রসভাতে যারা অংশগ্রহণ করবেন তারা উন্নতমানের টেলিস্কোপের মাধ্যমে এবং প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে রাতের আকাশ দেখার এবং বোঝার সুযোগ পাবেন। স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের সামনে নক্ষত্রসভা হলো সেই সুযোগ যা হয়তো তাদের অনেকের সামনে খুলে দেবে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে ভালোবেসে এই মহাবিশ্বের নানা অজানার রহস্য উন্মোচনের দরজা।
Starscapes এর ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত রাতের আকাশের একটি ছবি।
আশা রাখি অদূর ভবিষ্যতে উত্তরাখণ্ডের মতো আরোও অনেক রাজ্যের পর্যটন দপ্তর এবং শিক্ষা দপ্তরও যৌথভাবে Astro ট্যুরিজমকে প্রচার করবে এবং কে বলতে পারে হয়ত একদিন আমাদের পশ্চিমবঙ্গেরই কোনো এক প্রত্যন্ত জায়গায় বসে আমরা রাতের আকাশ নানা অজানা তারা, নক্ষত্র চিনতে শুরু করবো না ! Starscapes সম্পর্কে বিশদে জানার জন্যে তাদের ওয়েবসাইট-এর লিংক ব্যবহার করতে পারেন: https://starscapes.zone/
*লেখক বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার University of Witwatersrand এর পদার্থবিদ্যা বিভাগে গবেষক হিসাবে কর্মরত।
আরও পড়ুন
NASA Carbon Emission: পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে
উত্তরাপথঃ কার্বন নির্গমন (NASA Carbon Emission) সম্পর্কে নাসার সর্বশেষ আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য এক সতর্কতা সংকেত। মহাকাশ সংস্থার মতে, পৃথিবী কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার চেয়ে বেশি নির্গত করছে, যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। NASA এর এই আবিষ্কারটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, সেইসাথে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।নাসার সর্বশেষ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে পৃথিবীর মহাসাগর এবং ভূমি-ভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র আগের চেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে ভূমি এবং মহাসাগর দ্বারা শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৫% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে গ্যাসের বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন
World’s most polluted cities: নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়
উত্তরাপথঃ দিওয়ালি উদযাপনের একদিন পর জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় উঠে এসেছে।সোমবার, অর্থাৎ দীপাবলির পরের দিন এই শহরগুলির বায়ুর গুণমান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খারাপ হয়েছে।বায়ুর গুনমান খারাপ হওয়ার পেছনে মাত্রাতিরিক্ত আতশবাজি জ্বালানোকে দায়ী করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের (World’s most polluted cities) তালিকায় যথারীতি প্রথম স্থান দখল করেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। দীপাবলির পরের দিন এটির AQI (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) পরিসংখ্যান ছিল ৪০৭। নভেম্বরের শুরু থেকে, দিল্লিতে AQI পরিসংখ্যান খারাপ হয়েছে। সুইস গ্রুপ আইকিউএয়ার শহরের বাতাসকে "বিপজ্জনক" বিভাগে রেখেছে।ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়(World’s most polluted cities), ১৫৭ এর AQI সহ ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। কলকাতা ১৫৪ এর AQI সহ সপ্তম স্থানে রয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন
Vijay Stambh : চিতোরগড় দুর্গে বিজয় স্তম্ভ হিন্দু – মুসলিম সহাবস্থানের প্রতীক
উত্তরাপথঃ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে মৌর্য রাজবংশ কর্তৃক স্থাপিত চিতোরগড় দুর্গ সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ তার বিশাল কাঠামো, রাজপ্রাসাদ, একাধিক সুদৃশ্য মন্দির সহ সুন্দর জলাশয়ের জন্য বিখ্যাত।৭০০-একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এই দুর্গটিতে প্রায় ৬৫টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যা রাজপুত এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীর সূক্ষ্মতার প্রমান দেয়। বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh)) হল এই দুর্গে অবস্থিত,সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কাঠামো।এই আশ্চর্য-অনুপ্রেরণামূলক স্তম্ভটি কেবল তার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত নয়,এটি রাজপুতদের অদম্য সাহস এবং অধ্যবসায়ের গল্পও বলে যা চিতোরগড় দুর্গেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।বিজয় স্তম্ভ (Vijay Stambh), নাম থেকে বোঝা যায়, বিজয়ের প্রতীক। প্রাচীনকালে যে কোনো যুদ্ধ অভিযানের সাফল্যের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে রাজারা মন্দির, স্তূপ, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্তম্ভ নির্মাণ করতেন। ৯ তলা এই বিজয় স্তম্ভটি ১৯৪০ থেকে ১৪৪৮ সালের মধ্যে মহারানা কুম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। .....বিস্তারিত পড়ুন
Bandna Festival: ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাঁচ দিন বাঁদনার আমেজে মশগুল থাকে
বলরাম মাহাতোঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন থেকে মোট পাঁচ দিন ব্যাপী বাঁদনার(Bandna Festival) আমেজে মশগুল থাকে ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য, পরবের শুভ সূচনা হয় তারও কয়েকদিন আগে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক শাসন ব্যবস্থার চূড়ামণি হিসাবে গাঁয়ের মাহাতো, লায়া, দেহরি কিম্বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্ধারণ করেন- ৩, ৫, ৭ বা ৯ ক’দিন ধরে গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখাবে গৃহস্বামী! রুখামাটির দেশের লোকেরা কোনোকালেই মাছের তেলে মাছ ভাজা তত্ত্বের অনুসারী নয়। তাই তারা গোরুর শিং-এ অন্য তেলের পরিবর্তে কচড়া তেল মাখানোয় বিশ্বাসী। কারণ কচড়া তেল প্রস্তুত করতে গোধনকে খাটাতে হয় না যে! কচড়া তেলের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে সরষের তেল ব্যবহৃত হলেও, কচড়া তেলের ধারণাটি যে কৃষিজীবী মানুষের গবাদি পশুর প্রতি প্রেমের দ্যোতক, তা বলাই বাহুল্য! এভাবেই রাঢ বঙ্গে গোবর নিকানো উঠোনে হাজির হয়- ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরইয়া, বুঢ়ি বাঁদনা ও গুঁড়ি বাঁদনার উৎসবমুখর দিনগুলি। পঞ্চদিবসে তেল দেওয়া, গঠ পূজা, কাঁচি দুয়ারি, জাগান, গহাইল পূজা, চুমান, চউক পুরা, নিমছান, গোরু খুঁটা, কাঁটা কাঢ়া প্রভৃতি ১১টি প্রধান পর্ব সহ মোট ১৬টি লোকাচারের মাধ্যমে উদযাপিত হয় বাঁদনা পরব(Bandna Festival )। .....বিস্তারিত পড়ুন