ড. সায়ন বসু
“এঙ্কেলাডাসের অন্তঃস্থল (Core) এবং বরফপূর্ণ ভূত্বকের (Icy crust) মাঝে জলের সম্ভাব্য অবস্থানের একটি রৈখিক চিত্র | ছবি – Demotix/Corbis.”
গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী গায়া (Gaia) এবং উরেনাস (Urenus)-এর সন্তান এঙ্কেলাডাস (Enceladus) ছিলেন একজন দৈত্য | দেবতা এবং দৈত্যদের যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন যুদ্ধ এবং জ্ঞানের দেবী এথেনার (Athena) বিপক্ষে | এমনও মনে করা হয় যে এঙ্কেলাডাসকে ইতালির সিসিলিতে অবস্থিত এতেনা (Etena) পর্বতের নীচে সমাধি দেওয়া হয় | বলা হয়ে থাকে ভূমিকম্প এবং অগ্ন্যুৎপাতের জন্যে নাকি তার নিঃশ্বাস দায়ী | ঠিক তেমনই শনির একটি ছোট উপগ্রহ যার নামও এঙ্কেলাডাস তা থেকেও প্রচুর পরিমানে ফসফরাসের হদিশ পাওয়া গেছে যা কিনা বৈজ্ঞানিকদের বেশ অবাক করে দিয়েছে | এর হদিশ দিয়েছে নাসার অন্যতম মহাকাশযান ক্যাসিনি (Cassini) যা ১৯৯৭ সালের ১৫ই অক্টোবর পাঠানো হয় শনি গ্রহকে আরোও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে এবং তার উপগ্রহগুলিকেও পর্যবেক্ষণ করে তাদের সম্বন্ধে নতুন নতুন তথ্য পাঠানোর জন্যে |
এই মহাকাশযানটির কার্যকাল ছিল ২০ বছর (১৯৯৭ – ২০১৭) ! ২০০৪ থেকে ২০১৭ এর মধ্যে ক্যাসিনি ২৯৪ বার শনিকে প্রদক্ষিণ করেছে, ৪ লক্ষের বেশি ছবি পাঠিয়েছে, আবিষ্কার করেছে শনির ৬টি উপগ্রহের, সাথে এঙ্কেলাডাস এবং টাইটান নামের দুটি উপগ্রহে যে “প্রাণের সন্ধান” মিললেও মিলতে পারে সে সম্বন্ধেও জানিয়েছে বৈজ্ঞানিকদের| ২০১৭ তে এর কার্যকাল শেষ হলে মহাকাশযানটিকে শনির বায়ুমণ্ডলের মধ্যে নিমজ্জিত করে দেওয়া হয় যাতে করে এটি কোনোভাবে শনির উপগ্রহগুলির সাথে না ধাক্কা খায়|
ক্যাসিনির পাঠানো তথ্যগুলির মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় হলো শনির বলয় | জানা গেছে যে বলয়টির বাইরের অংশটি প্রধানত টুকরো টুকরো বরফ এবং এঙ্কেলাডাস নামক উপগ্রহ থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা জল দিয়েই তৈরি হয়েছে ! জলের বিচ্ছুরণটি মূলত আবিষ্কার হয় ২০০৮ সালে যখন ক্যাসিনি তার মধ্যে দিয়ে উড়ে যায়| সাথে ক্যাসিনির পাঠানো তথ্য থেকে এও জানা গেছে যে এঙ্কেলাডাসের মধ্যে মজুত আছে প্রচুর পরিমানে জৈব যৌগ যার মধ্যে আছে কার্বনও | এই আবিষ্কার এঙ্কেলাডাসকে করে তুলেছে এক সম্ভাবনাময় জগৎ যেখানে বৈজ্ঞানিকরা মনে করছেন প্রাণের সন্ধান পাওয়া গেলেও যেতে পারে ! ২০০৮ সালে ক্যাসিনির পর্যবেক্ষণ ব্যবহার করে জার্মানির বার্লিনে অবস্থিত ফ্রি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক পোস্টবর্গ এবং তার সহ বৈজ্ঞানিকরা এই আবিষ্কারটি তুলে ধরেছেন | তাদের গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে নেচার অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালের ১৪ই জুনের সংখ্যায় |
জীবনের অস্ত্বিতের জন্যে যে উপাদানগুলোকে প্রধান বলে ধরা হয়, তাদের একসাথে বলে CHNOPS : কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস এবং সালফার | এগুলির মধ্যে বিরল যেটি তা হলো ফসফরাস এবং এই ফসফরাসেরই সন্ধান পাওয়া গেছে এঙ্কেলাডাসে | এখানে বলে রাখা ভালো যে শনির এই উপগ্রহ বা “চাঁদ”-এর দক্ষিণ মেরুতে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পুরু বরফের নীচে রয়েছে প্রায় ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত সমুদ্র| এর আগে এঙ্কেলাডাসের সমুদ্রে কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, সালফার এবং অক্সিজেন-এর উপস্থিতি প্রমান হলেও ফসফরাস-এর উপস্থিতির প্রমান বৈজ্ঞানিকদের কাছে এক নতুন দিক খুলে দিয়েছে | ফসফরাসের উপস্থিতি নিয়ে এতো কথা তার কারণ, ফসফরাস হলো সেই উপাদান যার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে DNA এবং RNA -এর কাঠামো তৈরী করতে | নতুন গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে এঙ্কেলাডাসের “সমুদ্রে” যে পরিমান ফসফরাস আছে তার পরিমান আমাদের পৃথিবীর সমুদ্রে পাওয়া ফসফরাসের থেকে প্রায় ৫০০ গুন বেশি | অন্য পাঁচটি উপাদানের সাথে ফসফরাসের এই উপস্থিতি এঙ্কেলাডাসের বুকে “প্রাণের অস্ত্বিতের” সম্ভাবনা বেশ কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে বললেও ভুল কিছু বলা হবে না | অধ্যাপক পোস্টবর্গ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমরা সম্প্রতি যা খুঁজে পেয়েছি তা সংকেত দেয় যে এঙ্কেলাডাসে প্রাণের সম্ভাবনা প্রবল”| এই আবিষ্কারটি এতো গুরুত্বপূর্ণ তার কারণ হলো এঙ্কেলাডাসে পাওয়া ফসফরাস রয়েছে দ্রবীভূত অবস্থায় যার জন্যে একে বলা হচ্ছে “সোডার সমুদ্র” (Soda ocean) | সোডার সমুদ্র বা হ্রদগুলিতে (যেমন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার মনো লেক বা ভারতের মহারাষ্ট্রের লোনার লেক বা হ্রদ) প্রচুর পরিমানে কার্বনেট থাকে | এই কার্বনেট পরে অন্য উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম ইত্যাদির সাথে মিশে যায় এবং পরে থাকে ফসফরাস যা কিনা শৈবাল-এর জন্মের জন্যে কাজে লাগে | তাই বোঝাই যাচ্ছে প্রাণের সঞ্চার হওয়ার জন্যে ফসফরাস কতটা জরুরি|
সবকিছু মিলিয়ে এই আবিষ্কার একটা পুরনো প্রশ্ন বোধ হয় আবার তুলে দিল, “মহাবিশ্বে কি আমরা একা, নাকি আরও কেউ আছে”? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হলে আমাদের হয়ত আরও এক দশক বা তারও বেশি অপেক্ষা করতে হবে কিন্তু শনির “চাঁদে” খুঁজে পাওয়া ফসফরাস বোধ হয় ওই প্রশ্নের উত্তরের একটা সূত্র রেখে গেলো |
* লেখক বর্তমানে University of Witwatersrand-এর Centre for Astrophysics-এ কর্মরত রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির গবেষক
যোগাযোগ- sayan.basu@wits.ac.za
আরও পড়ুন
আমন্ত্রণপত্রে, বর ও কনের নামের সাথে আইআইটি লেখায় বিতর্ক সোশ্যাল মাধ্যমে
উত্তরাপথঃ বিবাহের সময়, অভিনব এবং ডিজাইনার আমন্ত্রণ কার্ডগুলি সর্বদা সকলের আলোচনায় পরিণত হয়। কিছু আমন্ত্রণ পত্র বিলাসবহুল চকোলেটের সাথে কাস্টমাইজ করে বানানো হয়,আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরিবেশের কথা মাথায় রেখে বায়োডিগ্রেডেবল কার্ডের সাথে উপহার হিসাবে গাছ দেওয়া হয়। সম্প্রতি, একটি পুরাতন বিবাহের আমন্ত্রণপত্র ইন্টারনেটে ভাইরাল হচ্ছে যা বর এবং কনের শিক্ষাগত যোগ্যতা গুলিকে হাইলাইট করে বানানো হয়েছে । অর্থাৎ কার্ডে বর ও কনের নামের সাথে তাদের পড়াশোনার ডিগ্রিকেও যুক্ত করা হয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন
চম্পারন মাটন রাজনীতি কি কোনও নতুন সমীকরণ তৈরি করবে
উত্তরাপথঃ সামনে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচন ,আর সেই নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে INDIAজোট। মুম্বাইতে বিরোধী INDIA জোটের (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স) তৃতীয় বৈঠকের একদিন পরে, কংগ্রেস শনিবার রাহুল গান্ধীর লালু প্রসাদ যাদব এবং তার পরিবারের সদস্যদের সাথে দিল্লিতে দেখা করার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে তাদের চম্পারন মাটন দিয়ে রান্না এবং রাজনীতি নিয়ে আড্ডা দিতে দেখা যাচ্ছে।ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রাহুল গান্ধী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর জন্যও মাটন চাইছেন যা প্রিয়াঙ্কা বাড়িতে উপভোগ করেন এবং সন্দেহ করেছিলেন যে রাহুল সত্যিই মাটন রান্না করেছেন কিনা। "সবাই করেছে। আমি রান্না করেছি, লালুজি রান্না করেছে, মিসা রান্না করেছে," রাহুল বলল। .....বিস্তারিত পড়ুন
রেলওয়ে ইউনিয়নের নতুন সূচনা, গান গেয়ে মানসিক চাপ দূর করছেন রেলের কর্মচারীরা
উত্তরাপথঃ আপনি যদি সরকারি বা বেসরকারি চাকরি করেন, তাহলে এই খবর আপনাকে স্বস্তি দেবে।কারণ ভারতীয় রেলওয়ের বৃহত্তম শ্রমিক সংগঠন অল ইন্ডিয়া রেলওয়েম্যানস ফেডারেশন (এআইআরএফ) এবং নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের উপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমাতে এক অনন্য উদ্যোগ শুরু করেছে।তারা তাদের কর্মীদের গান গেয়ে তাদের মানসিক চাপ দূর করতে পরামর্শ দিচ্ছে। এআইআরএফ-এর সাধারণ সম্পাদক শিব গোপাল মিশ্র এবং কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মুকেশ মাথুরের নির্দেশে, জয়পুর এবং অন্যান্য শহরের কর্মচারীরা একটি মাঠে জড়ো হয় এবং সেখানে তারা গান গায় এবং আন্তাক্ষিরি খেলে। .....বিস্তারিত পড়ুন
আবার জেগে উঠবে চন্দ্রযান-৩-এর বিক্রম ল্যান্ডার,আশাবাদী ISRO
উত্তরাপথঃ চন্দ্রযান-৩-এর বিক্রম ল্যান্ডার বর্তমানে চাঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্ধকার চাঁদে বিক্রম ল্যান্ডার দেখতে কেমন? এটি জানতে চন্দ্রযান-২ অরবিটার পাঠানো হয়েছিল।চন্দ্রযান-২ অরবিটার বিক্রম ল্যান্ডারের একটি ছবি তোলেন।ISRO সেই ছবিটি প্রকাশ করেছে, যা রাতে চন্দ্রযান-3 ল্যান্ডার দেখায়।ISRO টুইট করে জানায় রোভার প্রজ্ঞানের পরে, এখন ল্যান্ডার বিক্রমও ঘুমিয়ে পড়েছে। ISRO প্রধান এস সোমনাথ এর আগে বলেছিলেন যে চন্দ্র মিশনের রোভার এবং ল্যান্ডার চান্দ্র রাতে নিষ্ক্রিয় করা হবে। তারা ১৪ দিন পরে আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে যখন সেখানে ভোর হবে। 23 আগস্ট চাঁদের দক্ষিণ পৃষ্ঠে অবতরণের পরে, ল্যান্ডার বিক্রম এবং রোভার প্রজ্ঞান উভয় ডিভাইস তাদের কাজ খুব ভাল .....বিস্তারিত পড়ুন