সর্বভারতীয় বাংলাভাষা মঞ্চের উদ্যোগে কলকাতায় বরাকের ভাষাশহিদ দিবস

উত্তরাপথ

গত ১৯শে মে বেলা একটায় উনিশের ঐতিহ্য ও শিক্ষা বিষয়ে একটি সমৃদ্ধ আলোচনা চক্র, কবি সম্মেলন ,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও  পদযাত্রার   মাধ্যমে পালিত হল কলকাতার সর্ব বৃহৎ উদযাপন । এই সেমিনার উদ্বোধন করেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  সহ উপাচার্য অধ্যাপক আশিসকুমার চট্টোপাধ্যায় , প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন প্রবীণ সাংসদ অধ্যাপক প্রদীপ ভট্টাচার্য , মুখ্য বক্তা ছিলেন প্রখ্যাত আইন জীবী ও সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য,  বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন  পশ্চিম বঙ্গ বাংলা  দলিত সাহিত্য আকাদেমির সভাপতি  মনোরঞ্জন ব্যাপারী আলোচক দের মধ্যে ছিলেন , অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তী, অধ্যাপক সনৎকুমার নস্কর,অধ্যাপক বরেন্দু মন্ডল,সাহিত্যিক কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর, সাহিত্যিক নকুল মল্লিক, বাকশিল্পী  রজত বন্দ্যোপাধ্যায়  ও কালান্তর পত্রিকার সম্পাদক  কল্যাণ ব্যানার্জি  এবং অনুষ্ঠানের সূচক বক্তা, সমাজ ভাষা গবেষক নীতীশ বিশ্বাস। সভা পতিত্বকরেন  মানভূম ভাষা  আন্দোলনের প্রবীণ সৈনিক কাজল সেন, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জ্যোতির্ভূষণ দত্ত ও  জাতীয়  শিক্ষক সূর্যাংশু ভট্টাচার্য ।

সূচক বক্তব্যে নীতীশ বিশিষ্ট বিশ্বাস আসামের ১৯শের শহিদানের থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন ভারতে যে বাংলা ও বাঙালি নিধন যজ্ঞ চলছে তার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের  ডাক দেন।আসামের দুর্ভাগ্যের ইতিকথা বলতে গিয়ে তিনি ১৮৭৪এর বরাকের আসাম ভূক্তির কথা তোলেন। তখন বাংলার উচ্চকোটির মানুষেরা যারা নবজাগরণের ঢক্কা নিনাদ করছিলেন বলে বা কোনো প্রতিবাদ করেছিলেন বলে আমরা জানিনা।   তিনি আরো বলেন,” পৃথিবীর শ্রেষ্ঠভাষা ক’টির একটি হল বাংলা, ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা।  পৃথিবীর মধুরতম ভাষা। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, সত্যজিৎ বাংলায় চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অস্কার পেয়েছেন। ভারতে এখন অবধি অন্য কেউ এ দুটি পুরস্কারের কোন একটিও পায়নি। ইউরোপের বাইরে বিশ্বে বাংলাই প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পায়। বাংলা সাংবাদিকতা আন্তর্জাতিক ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছে। এসব আমাদের অমিত গৌরব। ‌দেশ ভাগের আগে ভারতে বাংলাই ছিল জনগরিষ্ঠের ভাষা। পৃথিবীতে বর্তমানে বাঙালির সংখ্যা প্রায় ৩৮ কোটি। বাংলা দেশের রাষ্ট্রভাষা ১৯শে মে কে কেন্দ্র করে আমরা আজ  এদেশে আমাদের অস্তিত্বের লড়াই করতে চাই। কারণ  ভারতে ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমরা যে যুদ্ধ করতে চাই তার  রাস্তা তৈরি করেছে ১৯শে মে ১১শহিদ।

মুখ্য বক্তা  বিশিষ্ট আইন জীবী ও সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, বাংলার প্রধান শত্রু ‌আমরা বাঙালিরাই । আমরা আমাদের জীবনাচরণে বাংলা কে গুরুত্ব প্রদান করিনা।এই আত্মতঞ্চকতা আমাদের সর্বনাশ করেছে।এর থেকে দ্রুত পরিত্রাণ প্রয়োজন।

প্রধান অতিথি সাংসদ অধ্যাপক প্রদীপ ভট্টাচার্য  বলেন, আমাদের আজ প্রয়োজন সব বাংলা ভাষা সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ  প্রয়াস।তার জন্য সর্বভারতীয় বাংলা ভাষা মঞ্চ  যে সব উদ্যোগ নিয়েছেন তা অসাধারণ তাদেরই  এই প্রচেষ্ঠা  নিতে হবে। তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা এই কাজের জন্য যথোপযুক্ত আমি আমার সাধ্যমত সাহায্য করব। 

অধ্যাপিকা সুমিতা চক্রবর্তী বলেন  খুবই কৌশলে দেশে হিন্দি চাপানো হচ্ছে ও হয়েছে।  রাজ্যের সবধরনের সব মাধ্যমের স্কুলে বাংলা আবশ্যিক ভাবে পড়ানোর জন্য উচিত । অধ্যাপক সনতকুমার নস্কর বলেন শিক্ষক ও অধ্যাপকদের বাংলা ভাষার দাবি গুলি নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করা ও ধ্রুপদী ভাষার ব্যাপারে তাদের অনেক বেশী সোচ্চার  হওয়া দরকার।

 উদ্বোধক অধ্যাপক আশিস চট্টোপাধ্যায় নীতীশ বিশ্বাসের নিরলস প্রয়াসের উল্লেখ করে  এই আন্দোলনের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন । অনুষ্ঠানে তিনি ফাতনা পত্রিকার ১৯সে মে সংখ্যার উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে বিশ্বজিত রায়ের ১৯শে মে পত্রিকার একটি সংখ্যা প্রকাশ করা হয়।  

সভাশেষে ভাষা পদযাত্রা মাইক ও ট্যাবলো নিয়ে  ধর্ম তলার ওয়াই চ্যানেল পর্যন্ত যায়। এবং  সেখানে সমাপ্তি অনুষ্ঠানে অনেকেই কবিতা ও গানে তাদের শ্রদ্ধা জানান। যোগদান করেন। সভায় নিন্মোক্ত “ ১৯শের খোলা চিঠি” প্রকাশ করেআহবান  জানানো হয়ঃ ভারতে আমাদের মাতৃভাষা আজ এক মৃতস্রোতা নদীর মত । সমাজ ও সভ্যতা বিরোধী শাসক শক্তি হিটলারের আদর্শে দলিত দরিদ্র হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালিকে, জার্মানির ৬০ লক্ষ ইহুদীদের মত নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।   আসামের বাঙালি সহ অনসমিয়ারা তাদের মাতৃভাষার  অধিকার হরণের অসাংবিধানিক ফতোয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৬১র ১৯শে মে, একদিনে ১১জন বাংলাভাষী  প্রাণদেন । যারা বিশ্বের ভাষা আন্দোলনে অমর হয়ে আছেন । বরাকবাসী  এর ফলে অর্জন করেছিলেন তিনটি জেলার জন্য শিক্ষা ও সার্বিক প্রশাসনে  বাংলাভাষা ব্যবহারের অধিকার। সে  অমর শহিদের  নামের তালিকা হলঃ ১।  কমলা ভট্টাচার্য, ২।শচীন্দ্র পাল, ৩। সুনীল  সরকার ৪। বীরেন্দ্র সূত্রধর ৫। কানাইলাল নিয়োগী, ৬। সুকোমল পুরকায়স্থ ৭। চন্ডীচরণ সূত্রধর ৮।সত্যেন্দ্র দেব।৯। হীতেশ বিশ্বাস,১০। কুমুদরঞ্জ দাস ১১। তরণী   দেবনাথ। এই আন্দোলনে আহত হয়ে ২১ বছর যাবত যন্ত্রণাক্লিষ্টভাবে জীবন কাটিয়ে মৃত্যুবরণ করেন কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস ।  এপথেই যখন আবার . মাতৃভাষা বাংলার পরে আক্রমণের  প্রতিরোধে ১৭ই আগস্ট ১৯৭২ করিমগঞ্জে শহিদ হয়েছেন বিজন চক্রবর্তী (বাচ্চু)। তিনি ডি. ওয়াই. এফ. এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এরপর ১৯৮৬ সালে ২১শে জুলাই শহিদ হন  দিব্যেন্দু দাস (যীশু) ও জগন্ময় দেব। ১৯৯৬ সালের ১৬ই মার্চ করিম গঞ্জে প্রাণদেন মণিপুরী কন্যা সুদেষ্ণা সিংহ।  

নানা অবিচার চললেও বিষয়টি এতোদিন কমবেশি  অক্ষুন্নই ছিল। কিন্তু সম্প্রতি আসামে বিজেপির শাসন কালে বাঙালিদের উপর আইনী পথে ভয়ংকর বে-আইনী ও অসংবিধানিক নানা পদক্ষেপ তারা দিয়ে চলেছে। নাগরিকপঞ্জির নামে প্রথমে ৪০ লক্ষ পরে ১৯লক্ষ ভোটারকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ঘোষণাকরে।তার সবই প্রায় বাঙালি-হিন্দু  । এমন কি তারা এখন সরকারের গৃহীত ভাষা আইনও অমান্য করে বরাকে অসমিয়া পড়া চালু করতে উঠেপড়ে লেগেছে । অন্য দিকে আপাত ভালো কথার আড়ালে   নয়া শিক্ষানীতির নামে কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত  হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের বুলডোজার চালাতে শুরু করেছে সারা দেশে  । তার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের বঙ্গভাষী ভারত বাসীকে ঐক্যবদ্ধ না হলে ভারতে  বাংলাভাষী মানে  বাংলাদেশী  বলে ডিটেনশন  ক্যাম্পে যেতে হবে। এভাবে চললে  আগামী শতাব্দীতে রবীন্দ্র-নজরুল-বিবেকানন্দ-সুভাষচন্দ্রের বাঙালি ও বাংলা ভাষা এদেশ থেকে  হারিয়ে যাবে।  হারিয়ে যেতে পারে ভারতে বাঙালির শেষ ভূখণ্ড এই পশ্চিম বং নামে রাজ্যও। এই ভয়ানক চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমরা  সমস্ত বাংলাভাষী ও গণতান্ত্রিক  সংগঠন ও পত্র পত্রিকার সাংবাদিক  আর মাতৃভাষাপ্রেমী পশ্চিমবঙ্গবাসীকে আহবান জানাই  মাতৃমুক্তিপণে যৌথ ভাবে আন্দোলনে সামিল হোন।  বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে  রাজ্যে ও দেশের জন্য এই  সমস্ত দাবি আদায়ে  ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হোন অন্য কোনপথ আর খোলানেই।“

প্রচুর জন সমাগমের এ সভার সুচনায় বেলা ১২টা থেকে শুরু হয় কবি সম্মেলন ও আসামের ভাষা আন্দোলনের পরিচিত সংগীতাঞ্জলি দিয়ে। কবি সম্মেলন উদ্বোধন করেন সাহিত্যিক  মনোরঞ্জন ব্যাপারী  এবং বরাকের ভাষা আন্দোলনের গান শোনান নেহালকুমার পাল ওআবৃত্তি করেন  পারমিতা ভট্টাচার্য ও শুব্রত চৌধুরীসহ ২০জন বিশিষ্ট কবিও  শিল্পীবৃন্দ ।                                              

    সভায় অংশগ্রহণকারী সম্মাননীয় অতিথিদের মধ্যে ছিলেনঃ  কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশিস সানা,  সিদ্ধার্থ সাহা, রফিকুল হোসেন,   মৃন্ময় প্রামানিক  ,প্রেসিডেন্সির শিক্ষক অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন,উত্তম বিশ্বাস,  মোস্তাক আহমেদ,পুষ্প বৈরাগ্য, অঞ্জন ঘোষ  ড. বিরাট বৈরাগ্য, মন্মথ বিশ্বাস, কল্যাণী ঠাকুর, ড.আশিস  হীরা । অভিজিত মণ্ডল, ।  সাংবাদিকঃ কিংশুক রায় (গণশক্তি), পল্লব রায়(বাল্মীকি টিভি, মণি মুখোপাধ্যায় (কৃষি সাহিত্য সংবাদ)), সুজিত সরকার (আলোক শিল্পী) পল্লব রায় বাল্মীকি টিভি ।।বন্ধু সংগঠনঃ সুশীল মাহাত (সচিব,লোকসেবক সংঘ)গোপাল চক্রবর্তী (বঙ্গসাহিত্য সম্মিলন)  চিত্রা লাহিড়ী(ভাষা শহিদ স্মারক সমিতি) সত্যেন মৈত্র জনশিক্ষা সমিতির পার্থ দে)   বিশ্বজিৎ রায় (১৯শে মে পত্রিকা)  সঞ্চালকছিলেন কবি  দিলীপ পাল,যূথিকা পাণ্ডে,ড.মহুয়া বিশ্বাস ও  চিত্রা সরকার আর সাংগঠনিক পরিচালনায় ছিলেন সুবোধ বিশ্বাস গৌরী হালদার, নবকুমার কর্মকার, তপন দাস,সন্দীপ বিশ্বাস, চিত্রা মিত্র, সঞ্জয় রায়,  অমিতাভ চক্রবর্তী, ড.প্রবীর লাহা,সমীর বরণ দাস,দুলাল কৃষ্ণ দাস,জয়ন্ত বিশ্বাস,অমর ঘোষাল ও  অভিজিত মল্লিক।   

খবরটি শেয়ার করুণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন


Snake Robot : এবার মহাকাশে সাপ রোবট পাঠাবে NASA

উত্তরাপথ: মহাকাশ অনুসন্ধানের সীমানা আরও বিস্তৃত করতে এবং বহির্জাগতিক পরিবেশের দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে NASA ক্রমাগত উদ্ভাবনী প্রযুক্তির সন্ধান করেছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হল Snake robot বা সাপের মতো রোবট তৈরি করা যা মহাকাশে নেমে যাবতীয় অনুসন্ধানের কাজগুলি করবে এবং সেই সাথে মহাকাশে বসবাসের ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ করবে। এই যুগান্তকারী সৃষ্টিতে মহাকাশ অভিযানে বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা রয়েছে, যা দূরবর্তী এবং প্রতিকূল পরিবেশে গবেষণার কাজ নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করবে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Vitamin-D: ভিটামিন ডি’র সেবন হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়

উত্তরাপথ: হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক সহ কার্ডিওভাসকুলার রোগগুলি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ।সম্প্রতি একটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা গেছে যে ভিটামিন ডি সম্পূরকগুলি ৬০ বছরের বেশি বয়সী লোকেদের হার্ট অ্যাটাক সহ যে কোনও বড় ধরনের কার্ডিওভাসকুলার অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে পারে৷ গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন ডি প্রায়ই "সানশাইন ভিটামিন" হিসাবে পরিচিত। এটি গ্রহণকারীদের মধ্যে স্ট্রোক সহ কার্ডিওভাসকুলার রোগ ৯% হ্রাস পেয়েছে । যা ২৮ জুন দ্য বিএমজে দ্বারা প্রকাশিত একটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। .....বিস্তারিত পড়ুন

Scroll to Top